পীরগঞ্জে ঘরবাড়িতে হামলা,অগ্নিসংযোগ,লুটপাট, ভাংচুর

অফিস ডেস্ক
প্রতিবেদন প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বার ২০২৫ | সময়ঃ ০২:৩৭
photo

পীরগঞ্জ (রংপুর)প্রতিনিধিঃ-‎১৬ দিনের শিশু কন্যাকে নিয়ে দুপুরে বারান্দায় খাবারের অপেক্ষায় গৃহবধু ফারজানা বেগম (২২)। পাশেই রান্না-বান্না শেষে খাবার বিতরণে ব্যস্ত ৬৫ বছরের শ্বাশুড়ি মন্জুয়ারা বেওয়া। হঠাৎ ১৫/২০ জন নারী পুরুষ হাতে ধারালো ছোরা, রামদা, পশু কুড়াল ও লাঠি নিয়ে হামলে পড়ে পুরুষহীন ওই পরিবারের উপর। তারা অস্ত্রের মুখে পরিবারের সকলকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে প্রথমে ঘর সংলগ্ন খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেয়। 

 

সামনে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। প্রতিবেশী জনৈক ব্যক্তি পীরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসে ফোন দিলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরই মধ্যে তারা হামলা চালিয়ে ঘরের বারান্দা, দরজা ভেঙ্গে ঘরে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র (ফ্রিজ, টিভি,খাট, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল) লুটে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ঘরগুলোতে থাকা লেপ-তোষক, পোষাক কাপড় এমনকি ছেলে-মেয়েদের বই-খাতাও বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তারা এতটাই অমানবিক ছিলো যে, গোয়ালের গরু, ছাগলগুলোকেও খাবার দিতে দিচ্ছে না। পুলিশের সহযোগীতা চেয়েও আমরা ব্যর্থ।

 

 খুনের মামলায় আসামি হয়ে স্বামীসহ ৫জন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে প্রতিপক্ষের অব্যাহত হুমকী-ধমকি ও ভয়-ভীতির কারণে প্রাণ ভয়ে ১৬ দিনের শিশুকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। বৃদ্ধা শ্বাশুড়ি মেয়ে জামাই বাড়িতে, বাকিরা গ্রাম ছাড়া। কথাগুলো বলছিলেন পীরগঞ্জের ভেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের ভুক্তভোগী গৃহবধূ ফারজানা বেগম।
 

‎রোববার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির দরজাটা ভাংচুর অবস্থায় দেয়ালে হেলানো। পাশেই ঘরের বারান্দা গুলো ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। ৩০ ও ৩১ আগষ্ট সকালে অব্যাহত হামলায় ঘরের জানালা, দরজাগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৬টি ঘরের অধিকাংশই অরক্ষিত তালাহীন। জন-মানবহীন ঘরগুলোতে লুটপাটের যে মহোৎসব চলেছে তা সহজেই প্রতীয়মান হয়। 

 

গৃহবধূ ফারজানা বেগমের উত্তর দুয়ারী পাকা দালানের ঘরটির মুল্যবান আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। কাগজপত্র ও কাপড়চোপড় এলোমেলোভাবে মেঝেতে পড়ে আছে। পাশের ঘরটিতেও অভিন্ন অবস্থা। মেঝেতে দশম শ্রেণীর বই খাতা ছিড়িয়ে ছটিয়ে পড়ে আছে। বই খাতা ও কাপড়চোপড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল, ঘরে থেকে ধুঁয়ার কুন্ডলী বের হচ্ছে। বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে ভাসছে লেপ-তোষক। পুকুরের অপর প্রান্তে ছোরা ও লাঠি হাতে দাড়িয়ে ২জন পুরুষসহ ২মহিলা ছোরা উঁচিয়ে নানা ভঙ্গি করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী তাদের পরিচয় নিশ্চিত করে বলেন, তারা- আব্দুল জলিল, তার স্ত্রী গোলাপী বেগম, পুত্র চাঁন মিয়া ও লাল মিয়ার স্ত্রী নুর জাহান বেগম।
 

‎গ্রামছাড়া ওই পরিবারে শিশু, বৃদ্ধাসহ ২১ সদস্যের বসবাস। মারমুখী প্রতিপক্ষের হুমকী ও ভয়-ভীতির কারণে পালিয়ে থাকা দশম শ্রেণীর স্কুল পড়ুয়া ছাত্র নিরব মিয়া (১৬)। সে এবার এসএসসি পরীক্ষর্থী। ভেন্ডাবাড়ী বাজারে কাকতালীয় ভাবেই দেখা হয় নিরবের। চোখ-মুখে অজানা আতংকে ভরা। হামলা ও লুটপাটের বর্ণনা দিতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলেন, ওরা আমার বই খাতা সবই নিয়ে গেছে- আমি পরীক্ষা দিবো কেমনে!
 

‎পালিয়ে মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত ৬৫ বছরের বিধবা বৃদ্ধা মন্জুয়ার বেগম অশ্রæসিক্ত চোখে বলেন, ওরা আমাদের বাড়ি থেকে এক কাপড়ে জোর করে অস্ত্রে মুখে তাড়িয়ে দিয়েছে। আপনারা থানা- পুলিশে অভিযোগ করছেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাবারে বাড়িটা পুরুষ শুন্য- অভিযোগ করবে কে!
 

‎গত ২০ আগষ্ট দুপুরে দু'পক্ষের সংঘর্ষে ৪ ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়। আহতদের মধ্যে পাকুড়িয়া গ্রামের আব্দুল জলিল মিয়ার পুত্র গোলাম মোস্তফা (৩৫) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার (২৪ আগষ্ট) মারা গেলে একই দিনে পীরগঞ্জ থানায় নিহতের ছোট ভাই চান মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা নং ৩৮/২০২৫। ‎এতে ১নং আসামী ভেন্ডাবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম, সাবেক চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন মন্ডল, ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আখেরুজ্জামান, ইউপি সদস্য এনামুল হক ও মেজবাহুর রহমানসহ বিভিন্ন এলাকার ৩০ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ে করা হয়।

 

 এতে ২০/৩০ জন অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অজ্ঞাতনামা তালিকায় আসামী করার ভয়ভীতি দেখানোর ফলে এলাকার কেউ মুখ খুলতে সাহস করছে না।
 

‎উল্লেখ্য উপজেলার ভেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের জনৈক আবুল কাশেম মিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশী আব্দুল জলিল মিয়ার ১ একর ৭৬ শতাংশ জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল।

 

 এ নিয়ে আদালতে উভয় পক্ষের মামলা পাল্টা মামলাও চলছিল। স¤প্রতি আবুল কাশেম মিয়া আদালতের একাধিক রায়, ভোগদখল, খারিজ খাজনা ও বর্তমান রেকর্ডমূলে উক্ত জমি একই ইউনিয়নের মাইকড় গ্রামের সামছুজ্জামান ওরফে ফুল মিয়ার নিকট বিক্রি করেন। ফুল মিয়া ক্রয়কৃত জমি চাষ করে চারা ধান রোপন করেন।
 

‎এদিকে আদালত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ২০ আগষ্ট (বুধবার) দুপুরে বিরোধপূর্ণ ওই জমি নিজেদের দাবি করে আব্দুল জলিলের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চারা ধান উপড়ে ফেলে এবং নতুন চারা ধান রোপন করার চেষ্টা করে। সংবাদ পেয়ে জমি ক্রেতা ফুল মিয়া ও তার লোকজন ঘটনাস্থলে এসে প্রতিবাদ করলে উভয়ের মাঝে বসচা হয়। 

 

বসার এক পর্যায়ে সংঘর্ষ বাধলে আব্দুল জলিলের পুত্র গোলাম মোস্তফা (নিহত)সহ প্রতিপক্ষের আজম মিয়া (২৮), তপন মিয়া (৩৫) ও হাফিজুর রহমান (৪৫) গুরুতর আহত অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৪ আগষ্ট গোলাম মোস্তফা প্রাণ হারায়। ‎এ ব্যাপারে ভেন্ডাবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর খায়রুল ইসলাম জানান, ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষে লিখিত অভিযোগ করলে আমরা দ্রæত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
 

মোঃ আকতারুজ্জামান রানা.পীরগঞ্জ

শেয়ার করুন