বাংলাদেশের রাজনীতিতে “একতরফা নির্বাচন” শব্দটি আজ একধরনের রাজনৈতিক অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

অফিস ডেস্ক
প্রতিবেদন প্রকাশ: ০৭ নভেম্বার ২০২৫ | সময়ঃ ০৯:৫৭
photo

ইতিহাস সাক্ষী — যে সরকারই একতরফা নির্বাচনের পথে গেছে, তাদের পরিণতি হয়েছে অবিশ্বাস, অস্থিরতা ও জনগণের রোষের মুখে পতন।

 

আওয়ামিলীগের আমলে যারা নির্বাচনী নাটকের চরিত্রে ভূমিকা নিয়েছিল, আজ তাদের অনেকেই ইতিহাসের পাঠশালায় লজ্জার পাতায় স্থান পেয়েছে। কেউ রাজনীতিতে অস্তিত্ব হারিয়েছে, কেউ জবাবদিহির মুখে জেলে, কেউ জনরোষের মুখে অপমানিত হয়েছে।

 

এখন আবারও যদি ২০২৬ সালে একই রকম একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটা হয়, তবে সেটি হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার সমান।

 

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। যে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, সেই জনগণই একদিন প্রতিশোধ নেয় — কখনো ভোটের বাক্সে, কখনো রাস্তায়।

 

একতরফা নির্বাচন শুধু বিরোধী দলকে বঞ্চিত করে না; এটি শাসক দলের ভিতকেও দুর্বল করে দেয়। কারণ একটি অবৈধভাবে টিকে থাকা সরকার নিজ দলের মধ্যেই আস্থাহীনতা, ভয় এবং সন্দেহ তৈরি করে। পরিণতিতে সেই সরকার নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে যায়।

 

যারা এখন মনে করছে “সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে”, তাদের জানা উচিত — নিয়ন্ত্রণের ভেতরেও ক্ষোভ জমে, ভয় কাজ করে, আর ইতিহাসের চাকা কখনো থেমে থাকে না। এক সময় সেই চাকা ঘুরে আবার ন্যায় ও জনগণের পক্ষে দাঁড়ায়।

 

তাই আজ সময় এসেছে ভাববার — যারা আজ একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করছে, তারা যেন মনে রাখে:ভোটের মাঠ একদিন আবার উন্মুক্ত হবে, আর তখন জনগণ বিচার করবে — কে তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল, কে ছিল ন্যায়ের পক্ষে।

বাংলাদেশ আজ এক অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করছে। জুলাই আন্দোলনের পর যে বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে — থানায় হামলা, অস্ত্র লুট, কারাগার থেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের পলায়ন — তা শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, আসন্ন নির্বাচনের জন্যও বড় এক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

রাজনীতির মাঠে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: এই হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলো কোথায়, কার হাতে, এবং নির্বাচনের সময় এগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে?

 

জুলাই আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন থানায় অস্ত্রাগার ভেঙে প্রচুর অস্ত্র ও গুলি লুটপাট হয়েছিল বলে রিপোর্ট রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বেশ কিছু উদ্ধার অভিযান চলছে — কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো স্বচ্ছ তথ্য জনগণকে জানানো হয়নি।

 

এই অস্বচ্ছতা আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে। কারণ নির্বাচনের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, ভোটকেন্দ্র দখল, ও সহিংসতা ঘটার আশঙ্কা থাকে। যদি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো এখনো মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, তবে সাধারণ ভোটারদের নিরাপত্তা প্রশ্নে বড় সংকট তৈরি হবে।

 

জুলাইয়ের অরাজকতার মধ্যে কারাগার ভেঙে কিছু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী পালিয়ে গেছে — এই খবর শুধু ভয় নয়, এক বাস্তব হুমকি। এরা সংগঠিত হয়ে ভোটকালীন সহিংসতা উস্কে দিতে পারে, কিংবা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ভাড়াটে বাহিনীতে পরিণত হতে পারে।নির্বাচনের আগে যদি এসব পলাতক জঙ্গিদের অবস্থান নির্ধারণ ও গ্রেপ্তার না করা যায়, তাহলে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে — এবং জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে।

 

নির্বাচন শুধু ভোটের সংখ্যা নয়; এটি আস্থার বিষয়। যদি মানুষ বিশ্বাস হারায় যে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিরাপদ থাকবে, তাহলে ভোটার উপস্থিতি কমে যাবে।একদলীয় বা একতরফা নির্বাচনের আশঙ্কা যেভাবে রাজনৈতিক পরিবেশে ঘনিয়ে আসছে, তার সঙ্গে যদি নিরাপত্তাহীনতা যোগ হয় — তবে নির্বাচনের বৈধতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

 

এই পরিস্থিতিতে সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এখনই তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া:

অস্ত্র উদ্ধারের অগ্রগতি প্রকাশ করা — জনগণকে জানাতে হবে কত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, কত বাকি, কোথায় অনুসন্ধান চলছে।

 

পলাতকদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান চালানো — বিশেষত সীমান্তবর্তী ও পাহাড়ি এলাকায়।

নির্বাচন-পূর্ব নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রকাশ করা — যেন জনগণ জানে, তারা নিরাপদে ভোট দিতে পারবে।

 

যদি এই বিষয়গুলো অমীমাংসিত থাকে, তাহলে নির্বাচনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো একে অপরকে দায়ী করবে। সহিংস ঘটনার পর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা আরও নষ্ট হবে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।

 

২০২৬ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রেখে যাওয়া নিরাপত্তাহীনতা যদি এখনই সমাধান না হয়, তবে এই নির্বাচন হতে পারে এক নতুন অরাজকতার সূচনা।

 

অস্ত্র লুট, জঙ্গি পলায়ন, এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা—এই তিনটি বিষয় নিয়ন্ত্রণে না আনলে আসন্ন নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক নয়, জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্কটে পরিণত হবে।

 

জনগণ এখন জানতে চায় — সেই অস্ত্রগুলো কোথায়, পলাতকরা কোথায়, আর তাদের নিরাপত্তা কে দেবে?

 

শেয়ার করুন