রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
22 Apr 2025 04:06 pm
![]() |
কবিতা যখন হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সমষ্টিগত চেতনার একত্র সমীকরণ, তখন সেটিই পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে থাকে দীর্ঘকাল। কবি কবির হোসেন মিজি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ লাল রঙের নামতা'য় তুলে এনেছেন ঠিক এমনই কিছু ক্ষরণ, কিছু প্রতীক্ষা, কিছু প্রতিবাদ, কিছু স্মৃতিমগ্ন সুর-যা একান্তই ব্যক্তিগত হয়েও পাঠকের আপন হয়ে ওঠে।
প্রায় ৪০টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থে যেমন রয়েছে মা-বাবা-ভালোবাসার আবেগ, তেমনি রয়েছে সমাজ, দেশ, রাজনীতি, বিবেক, প্রতিবাদ ও মানবতার ভাষ্য। বইটির সূচিপত্র থেকে প্রতিটি শিরোনামই যেন একটি আলাদা গল্প- একটি স্বতন্ত্র বোধের প্রবেশপথ।
কবি'র কথা থেকেই স্পষ্ট, তিনি কবিতাকে দেখেন আত্মার উন্মুক্ত উচ্চারণ হিসেবে। তিনি বলেন, জীবন আমাকে বেদনার সাগরে বহুবার নিক্ষিপ্ত করেছে, স্রোতের উর্ধ্বে নাক উঁচিয়ে আমি গোগ্রাসে গিলেছি কবিতার সঞ্জীবনী অমৃত।
এই উক্তিতে শুধু আত্মপ্রকাশই নয়, ধ্বনিত হয় কবিতার প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা ও আত্মিক বন্ধন। তাঁর কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা কোনো বাহ্যিক প্রাপ্তি বা স্বীকৃতি নয়, বরং একান্ত হৃদয়লব্ধ আনন্দ ও স্বস্তির প্রয়াস। এই নির্লোভ মনোভাবই তাঁকে করে তুলেছে একজন হৃদয়বান কবি।
এ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রায় চল্লিশটি কবিতার মাঝে দুটি কবিতা আমার হৃদয়ে বিশেষভাবে দাগ কেটেছে- “মায়ের শূন্যতা” এবং “দেহ বন্ধক”।
মায়ের শূন্যতা, এই কবিতাটি পড়ার পর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। মা শুধু একজন মানুষ নয়, তিনি আমাদের জীবনের শিকড়, আমাদের সমস্ত অস্তিত্বের আশ্রয়। কবিতার প্রতিটি স্তবক যেন একেকটি অনুভবের সুতার টানে আমাকে টেনে নিয়েছে অতীতের স্মৃতিগুলোয়। এখানে “মা”র অভাব কেবল শারীরিক অনুপস্থিতি নয়, বরং এক শূন্যতা, যা হৃদয়ের গহীনে দীর্ঘশ্বাস হয়ে জমে থাকে।
এই কবিতায় যেন আমি নিজেকেই খুঁজে পেলাম- এক সন্তান, যে এখনও মায়ের গন্ধ খোঁজে পুরনো শাড়ির ভাঁজে।
আর “দেহ বন্ধক” কবিতাটি আমাকে নাড়া দিয়েছে ভিন্ন এক অনুভবে। কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে, এ যেন আমাদের চারপাশের বাস্তবতার এক প্রতিবিম্ব, যেখানে মানুষ জীবনের প্রয়োজনে, সমাজের চাপ আর অপ্রাপ্তির জালে জড়িয়ে নিজের দেহ, আত্মা, এমনকি স্বপ্নও বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়।
কবি'র ভাষা এখানে যেমন শক্তিশালী, তেমনি ব্যথাতুর। আমি মনে করি, এই কবিতাটি শুধু পড়বার নয়, ভাববার এবং প্রশ্ন করার- আমরা কীভাবে বাঁচছি, কী হারাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
“লাল রঙের নামতা” শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, এটি এক আবেগভরা জীবন-সম্ভার। প্রতিটি কবিতা যেন জীবনের নামতার একটি হিসেব, একটি পদ্যরূপে লেখা ব্যথার অঙ্ক।
কবি'র লেখনী সরল, তবে গভীর। শব্দচয়ন সহজ হলেও তা পাঠকের অন্তর্দৃষ্টি স্পর্শ করে। কবিতাগুলোতে রয়েছে ছন্দের ধারাবাহিকতা, কখনো কখনো গদ্যছন্দের মধ্যেও কবিতা হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ।
শৈলীর দিক থেকে, কবিতা আধুনিক, অনেক সময় বাস্তববাদী, আবার কখনো বিমূর্ততা ও রূপকের আশ্রয়ে স্বপ্নিল। প্রেম, প্রস্থান, প্রতিবাদ, প্রকৃতি, পিতা-মাতা, দেশপ্রেম- সবই জায়গা করে নিয়েছে কবি'র বর্ণনাভাষ্যে।
“লাল রঙের নামতা” একটি আশাবাদী শুরু। কবি কবির হোসেন মিজি নিজের অভিজ্ঞতা, অনুভব ও বোধের মিলন ঘটিয়েছেন কাব্যিকভাবে। পাঠক এই বইয়ের ভেতর খুঁজে পাবেন নিজেকে, হয়তো হারানো মায়ের মুখ, কিংবা সমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
এই গ্রন্থ পাঠ শেষে পাঠকের মনে থাকবে কবিতার প্রতি একটি বিশ্বাস, যে বিশ্বাস বলে- “সব কষ্টই একদিন কবিতা হয়ে ওঠে। আর সেই কবিতা একদিন হয়ে ওঠে আমাদের জীবনেরও নামতা।”
- আহমেদ শাহেদ,কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও পেশাদার বাচিক শিল্পী।