সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
10 Feb 2025 08:04 pm
![]() |
৭১ভিশন ডেস্ক:- অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এর বিশেষ অভিযানে গত শনিবার রাত থেকে গতকাল রবিবার দুপুর পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।গ্রেপ্তারকৃত অনেকের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্র। গ্রেপ্তারকৃতদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।এ ছাড়া গ্রেপ্তারের তালিকায় রয়েছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যত দিন প্রয়োজন তত দিন এই অভিযান চলবে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমুল গনি বলেছেন,দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলেই করা হবে গ্রেপ্তার।গত শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, শুক্রবার রাতে গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় গত শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।
শনিবার থেকেই গাজীপুর এলাকাসহ সারা দেশে এই অভিযান শুরু হয়।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে গাজীপুরের কারণে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছে, সেই গাজীপুর শহরে বর্তমানে চলছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক।আর গাজীপুর থেকে যে ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ৩৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে জানান, যৌথ বাহিনীর অভিযানে শনিবার বিকেল থেকে গতকাল রবিবার দুপুর পর্যন্ত সারা দেশ থেকে এক হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অন্যান্য মামলার আসামিও রয়েছেন। এর মধ্যে মেট্রোপলিটন এলাকাগুলো থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৭৪ জনকে। আর জেলা পর্যায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক হাজার ৩৪ জন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন ও জেলা মিলিয়ে ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে রাজশাহীতে চারজন, নোয়াখালীতে ১১ জন, রাজবাড়ীতে তিনজন, রাঙামাটিতে তিনজন এবং শেরপুরে ১০ জন গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গাজীপুরে গ্রেপ্তার ৬৫ জন : গাজীপুরে ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’ মোট ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গাজীপুর জেলার পাঁচটি থানায় ৪০ জন এবং মহানগরের আট থানায় ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণের পৃথক ঘটনায় নগরীর সদর থানায় রবিবার দুটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৩৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। তাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভাতিজা আমজাদ মোল্লা ও তাঁর স্ত্রী সাবিনা রয়েছেন। আসামিদের প্রত্যেককে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
এদিকে অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযান শুরুর প্রথম দিনে গাজীপুরে গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে গেছেন দাখিন খান ও হায়দারাবাদ এলাকার নারী-পুরুষ। জানা গেছে, শুক্রবার রাতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল বিকেলে নগরীর সদর থানায় মামলা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গাজীপুরের আহবায়ক আবদুল্লাহ আল মুহিম। ২৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে দায়ের করা মামলার এজাহারে অজ্ঞাত পরিচয় আরো ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের সবাই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থক। প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভাতিজা আমজাদ হোসেন মোল্লাকে।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনায় একই থানায় আরেকটি মামলা হয়েছে। গুলিতে আহত সমন্বয়ক সদস্য মোবাশ্বের হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন বলে জানিয়েছেন সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত্ম) মো. সিদ্দিক হোসেন।
পরিদর্শক মো. সিদ্দিক হোসেন বলেন, দুই মামলায় ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর মহানগর আদালতে পাঠিয়েছে। প্রত্যেকের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, গ্রেপ্তার ৩৪ জনের মধ্যে ১৬ জনকে শুক্রবার রাতে ও ১৮ জনকে শনিবার রাতে আটক করা হয়।
গাজীপুরে প্রচুর অস্ত্র ঢুকানো হয়েছে : গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ঢুকিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান। গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরো বলেন, ‘গাজীপুরকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। শনিবার সন্ধ্যায় এক ছাত্রকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। ঘটনার কিছু আগে আমরা সেখানে ছিলাম।’ ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। কিছুদূরে সেনাবাহিনী ছিল। বিজিবিও ছিল। তার মধ্যেই তারা গুলি করে একজনকে আহত করেছে। তারা অশান্ত করার জন্য সব কিছু করছে। তাদের অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘তারা জনগণকে ঘুমাতে দিতে চায় না। আমরা তাদের সমুচিত জবাব দিব। কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদের রাঙা চোখ বরদাস্ত করা হবে না। এরই মধ্যে ছাত্রদের ওপর হামলা ও গুলির পৃথক ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গাজীপুরের দক্ষিণ খান ও হায়দারাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়ির সামনের বিশাল গেটটি বন্ধ। ফটকের সামনে কাচের ভাঙা টুকরা ও কয়েকটি সম্মাননা স্মারক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙচুরের দৃশ্য। বাড়ির বাইরে ও গেটে দুপুরেও জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। লোকজন না থাকায় সুনসান নীরবতা। বাড়ির সামনে মসজিদের দরজায়ও ঝুলছে তালা। আশপাশের সব বাড়িতেই ঝুলছে তালা। নেই কোনো জনমানব।
কিছুদূর গেলে দেখা মেলে এক ব্যক্তির। মন্ত্রীর আত্মীয় ওই ব্যক্তি বলেন, তার দুই ছেলে ও এক বোনকে পুলিশ শুক্রবার রাতে ধরে নিয়ে গেছে। তারা মারধর বা এ ধরনের কোনো ঘটনায় জড়িত নয়। গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকার মানুষ ঘরে তালা দিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। মসজিদের মুয়াজ্জিনও পলাতক। একই অবস্থা পাশের হায়দারাবাদের। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গতকালও এলাকার অনেক দোকানপাট ছিল বন্ধ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বললেন : গতকাল ফার্মগেটের মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের নতুন মৃত্তিকা ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ডেভিল’ যত দিন শেষ না হবে তত দিন পর্যন্ত অপারেশন ডেভিল হান্ট চলবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা দেশকে অস্থিতিশীল করবে, তাদের টার্গেট করে ডেভিল হান্ট অপারেশন চলবে। গাজীপুরে যারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছে, তাদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাকিদেরও আনা হবে।’
দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলেই গ্রেপ্তার : গতকাল সকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অপারেশন ডেভিল হান্ট সম্পর্কে এক প্রেস ব্রিফিং করে স্বরাষ্ট্রসচিব নাসিমুল গনি। তিনি বলেন, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, তাদের অপারেশন ডেভিল হান্টের আওতায় এনে গ্রেপ্তার করা হবে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটাকে স্বাভাবিক করতে এই অপারেশন চালানো হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগে যে আকারে আইন প্রয়োগ করা হতো আমরা সেভাবে হাঁটতে পারব না। আইনের স্পিরিট নিয়ে কাজটা করতে হবে। সে জন্য আইন প্রয়োগের সঙ্গে যারা জড়িত সব স্টেকহোল্ডারদের একত্রিত হয়ে কিভাবে আইনটাকে প্রয়োগ করতে পারি, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’
কালের কণ্ঠ