সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২৫
27 Jan 2025 06:23 pm
আপনার এক পা বাংলাদেশে। আরেক পা ব্রিটেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডা, ভারত কিংবা অন্য কোনও উন্নত দেশে। আপনি বাংলাদেশকে টাকা কামানোর স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। চুরি-বাটপারি, ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধ বাণিজ্য, নোংরা হাতে লুটপাট করে ওই সব দেশে টাকা পাচার করেছেন। গড়ে তুলছেন সম্পদের পাহাড়।আপনার কাছে জাতি কী প্রত্যাশা করতে পারে? আপনি কিই-বা দিতে পারেন? নিঃসন্দেহে বলা যায়- দেওয়ার মতো আপনার কাছে কিছুই নেই! কারণ আপনি যে-দেশের আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন; খাবার খেয়েছেন; শুধু মোহের কারণে সেই দেশের সাথে প্রতারণা করছেন।আপনাকে জাতির কুলাঙ্গার বললে অত্যুক্তি হবে না বৈ কি!
বলছিলাম দেশের নিয়ম ভেঙে যারা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন; আমলা, ব্যাংকার, ব্যাবসায়ী হয়েছেন; অর্থ পাচার করেছেন- তাদের কথা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন এ বিষয়ে বলেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা মন্ত্রিত্ব লাভের সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি এ কাজ হয়ে থাকে, তাহলে আইন ও সংবিধান পরিপন্থী কাজ হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যম বলছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গোপনে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ‘রেসিডেন্স কার্ড’ রয়েছে বেলজিয়ামের। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুক্তরাজ্যের নাগরিক; সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জুনাইদ আহম্মেদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার ‘গ্রিন কার্ড’ (বৈধ অনুমতি) রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য ছিলেন- এমন ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব (রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড) থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিদেশি নাগরিকত্ব পেতে হলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো কোনো দেশে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড পাওয়ার পরের ধাপে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। সাবেক পাঁচজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নাগরিকত্ব রয়েছে যুক্তরাজ্যে। তারা হলেন- আ হ ম মুস্তফা কামাল, মো. তাজুল ইসলাম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মো. মাহবুব আলী। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা গ্রিন কার্ড রয়েছে সাবেক চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সাতজন সংসদ সদস্যের। তারা হলেন- আব্দুস শহীদ, নসরুল হামিদ, জুনাইদ আহম্মেদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ), মাহফুজুর রহমান ও সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ।
কানাডার নাগরিকত্ব রয়েছে- এমন ছয় জনের নাম পেয়েছে দুদক। তাদের মধ্যে একজন সাবেক মন্ত্রী, অন্যরা সাবেক সংসদ সদস্য। এর মধ্যে রয়েছেন আবদুর রহমান, মাহবুব উল আলম হানিফ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নাসিম), শামীম ওসমান, শফিকুল ইসলাম (শিমুল) ও হাবিব হাসান। সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব রয়েছে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এবং জাপানে থাকার অনুমতি (রেসিডেন্স কার্ড) রয়েছে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের। সাবেক সংসদ সদস্য (টাঙ্গাইল-২ আসন) তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির জার্মানির নাগরিক এবং সাবেক সংসদ সদস্য (ময়মনসিংহ-১১) এম এ ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
বিএনপি-জাপার কী অবস্থা: বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় নেই ১৮ বছর। এর আগে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তিনবার দলটি সরকার গঠন করে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেও দলটি সরকার গঠন করেছিল। এর বাইরে প্রায় সব সংসদে তাদের দলের প্রতিনিধি ছিলেন। তাদের কেউ কি বিদেশি নাগরিকত্ব গোপন করে এমপি-মন্ত্রী হয়েছিলেন কি না; সেটাও পরিষ্কার করা দরকার। অন্যদিকে দেশের আরেকটি বড় দল জাতীয় পার্টি।
এই দলটি প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে টানা ৯ বছর দেশ শাসন করেছিল। এর বাইরে তারা সব সময় সরকারের কাছাকাছি থেকে ক্ষমতা ভোগ করেছে।তাদের দলের নেতারা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। তাদের কেউ বিদেশি নাগরিক কি না- সেই প্রশ্ন উঠেছে। দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিদেশি নাগরিক বলে কিছু দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। যদিও এটা সত্য কিনা, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আশাকরি জাতীয় পার্টি একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিষয়টি খোলাসা করবে। আর যদি সেটা তারা না করে, তাহলে ‘সন্দেহ’ বা অপপ্রচার আরও ঘনিভূত হবে।মনে রাখতে হবে অপরাধ কখনো চাপা থাকে না। এটা প্রকাশ পায়- আজ নয়তো কাল। আর তখন সেটা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হয়ে থাকে।
বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত কিংবা অন্য কোনও দলের নেতা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন কি না; দুদককে সেই বিষয়টিও তদন্ত করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারে দ্বৈত নাগরিক আছে কি না: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন; তাদের কারো বিদেশি নাগরিকত্ব আছে কি না; তা প্রকাশ করা জরুরি। আশাকরি তারা নিজেরাই বিষয়টি খোলা করবেন। যদি তাদের কারো বিদেশি নাগরিকত্ব থেকে থাকে; তাহলে তিনি-তারা সংবিধান ভায়োলেট করে শপথ নিয়েছেন। তার বা তাদের উচিত পদত্যাগ করা। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস জার্মানির নাগরিক বলে গুঞ্জন রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আইনকানুন, বিধিবিধান ও নৈতিকতার তোয়াক্কা করত না। এই সরকার অবশ্যই নিয়ম মেনে দেশ পরিচালনা করবে- এটাই দেশের মানুষ প্রত্যাশা করছে।
বিদেশে সম্পদের পাহাড়: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপের পরিবারের যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক ফ্ল্যাট বা বাড়ি রয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) তাদের ওয়েবসাইটে গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন গোলাপ। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)। সালমান এফ রহমানের সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব থাকলেও তার ‘বাগানবাড়ি’ যুক্তরাজ্যে। সেখানে তার চারটি বাড়ি রয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কিনেছেন; যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৮ কোটি ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা)।
গত ৩১ অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি উল্লেখ করেছে সিআইডি। এর আগেই গত সেপ্টেম্বর মাসে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি তুলে ধরে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাড়ি রয়েছে লন্ডনে। তার এক মেয়ে আগে থেকেই লন্ডনে থাকেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমান কানাডার নাগরিক। দেশটির টরন্টো শহরে তার বাড়ি রয়েছে।
এ ছাড়া দুবাইয়ের আজমান শহরে তার আরেকটি বাড়ি রয়েছে। কানাডায় বাড়ি, ব্যবসাসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (নাসিম)। তার মেয়ে কানাডায় থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি রয়েছে মানিকগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদের। তার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। নাটোরের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুলের বাড়ি রয়েছে কানাডার টরন্টোর নিকটবর্তী স্কারবরো শহরে। গত বছরের শুরুতে বাড়িটি কেনা হয়।সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বাড়িটি কিনতে ১৭ লাখের বেশি কানাডিয়ান ডলার খরচ হয়েছে।
বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও তার ছেলের নামে দুবাইয়ে বড় ধরনের বিনিয়োগ থাকার বিষয়টি জানতে পেরেছে দুদক।
অনুসন্ধানে যুক্ত দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, তাদের সবার বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছেন তারা। অনুসন্ধান শেষে দ্বৈত নাগরিকত্বসহ বিদেশে বাড়ি-বিনিয়োগ ও টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য মামলায় উল্লেখ করা হবে।
অর্থপাচার: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গত ২ নভেম্বর এক সেমিনারে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে মোট কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়। ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক মাধ্যম ব্যবহার করে ১৭ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচারের কথা জানা যায়। বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ১২-১৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বলয় প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসা- এই ত্রিমুখী আঁতাত মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। সব প্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘ সময় ধরে দলীয়করণের চর্চা হয়েছে; গত ১৫-১৬ বছরে যার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি।এতে আমলাতন্ত্রকে কর্তৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক শক্তি আর তা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন এজেন্সিকে। ফলে এসব জায়গায় কতটুকু পরিবর্তন আনা যাবে, তা গুরুত্বপূর্ণ। যে পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশা করছি, তা যেন টেকসই হয়।যারা টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন।তিনি বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।আমরা আশা করব- দুদক যেন কেবল আশ্বাসই না দেয়। সেটার বাস্তব প্রতিফলনও ঘটাতে হবে।
বেগমপাড়া: কানাডার প্রধান নগরী টরন্টো। এটি কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের সবচেয়ে প্রিয় আবাসস্থল। সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।এটি ‘বেগমপাড়া’ নামে বাংলাদেশিদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। তবে বেগমপাড়া বলে সেখানে কোনও স্থানের নাম নেই। এটি কেবলই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া একটি নাম। সেখানে বাংলাদেশি প্রাসাদসম বিপুল সংখ্যক বাড়ি রয়েছে। টরন্টো নগরীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় এবং টরন্টোর আশপাশের ছোট ছোট শহর মিসিসওগা, হ্যামিল্টন, গুয়েল্ফ ও অন্টারিও লেকের পাড়ঘেঁষা উপশহরগুলোর প্রাসাদসম অট্টালিকা বা ‘লেকশোর অ্যাপার্টমেন্ট’ ক্রয় করে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বেগমপাড়া। এসব বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট সাধারণ কানাডীয় নাগরিক কিংবা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় থাকা বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নয়।
এগুলোর দাম প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি টাকার সমমূল্যের) থেকে শুরু করে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন ডলার (২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার সমমূল্যের) হয়ে থাকে। মূলত দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, আমলা, সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে নিয়ে কানাডায় এসব বাড়ি কিনেছেন। তাদের অধিকাংশ গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে সে-দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশে মাল কামানো (টাকা লুটপাট) শেষ হলে একটা সময় তারা উড়াল দেবেন সেখানে।
বিতর্কিত ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ এবং বেক্সিমকো গ্রুপসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান গত এক দশকে রপ্তানি আয় থেকে উপার্জিত ৫৮৮ মিলিয়ন ডলার দেশে আনেনি। ঢাকাভিত্তিক শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান ৫৫৯ মিলিয়ন ডলার এবং চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি। সব মিলিয়ে এই ৪০টি প্রতিষ্ঠান এখনো প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এসব আমলা, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে বলে আশাকরি।
এস আলম ও আজিজ খান: বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম। বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি থেকে পাওয়ার প্ল্যান্ট- সবই আছে এই গ্রুপের। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অনেক বেসরকারি ব্যাংক। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আটটি ব্যাংকের মধ্যে চারটি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুট করেছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকখাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এর মধ্যে কেবল এস আলম-ই অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। বিতর্কিত এই শিল্পপতি বাংলাদেশের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের নাগরিক ছিলেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি বাংলাদেশের নাগরিত্ব ত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ তিনি এখন সিঙ্গাপুরের নাগরিক। ব্যবসার নামে তিনি যে লুটপাট করেছেন; হয়তো সেই অপরাধের বিচার আর করা যাবে না। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরেই স্থায়ী নিবাসী (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) হিসেবে সিঙ্গাপুরে বসবাস করে আসছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। সম্প্রতি তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।
দেশটির আইনে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ না থাকায় আজিজ খানকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে। সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আজিজ খান রয়েছেন। আজিজ খান ১৯৮৮ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করছেন এবং ২০১৬ সালে সামিটের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুরে স্থানান্তর করেন। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ১১০ কোটি ডলার। সামিট গ্রুপ বাংলাদেশে জ্বালানি- বিশেষ করে বিদ্যুৎখাতের বড় ব্যবসায়ী। তার ভাই কর্নেল (অব.) ফারুক আওয়ামী লীগের নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী। বিগত সরকারের সময় এই গ্রুপ বিভিন্নভাবে সরকারের আনুকূল্য পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি: বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে যারা দেশে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হয়েছে; তারা প্রতারক। তারা এদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাদের শপথ গ্রহণই ছিল অবৈধ। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারহীনতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। তথ্য গোপন ও প্রতারণা করা ওই সব প্রভাবশালীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।তাদের অনেকে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।যারা কারাগারে আছেন; তাদের বিচার করাটা হয়তো সহজ। আর যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন;তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। যেসব রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ী অর্থপাচার করেছেন তাদের ছবিসহ সংবাদ প্রচার করতে হবে।এতে মানুষ তাদের আসল চেহারাটা দেখতে পাবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি।