মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
27 Nov 2024 06:38 pm
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ আজ ভয়াল ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২০১৩ সালের এদিন ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার দিন। ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় হামলা চালান জামায়াত-শিবির কর্মী
ও সাঈদী ভক্তরা।
উপজেলার বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় চার পুলিশ সদস্যকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা, আওয়ামী লীগ নেতা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে চালানো হয় হামলা। ভাঙচুর, লুটপাটের পাশাপাশি দেয়া হয় আগুন।নিহত চার পুলিশ সদস্য হলেন— গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার খামার ধনারুহা গ্রামের নাজিম উদ্দিন, রংপুরের পীরগাছা উপজেলার রহমতচর গ্রামের তোজাম্মেল হক, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার কিশামত গোবধা গ্রামের হজরত আলী ও বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ঠাকুরপাড়ার বাবলু মিয়া।
তাদের মৃত্যুর ১০ বছর হয়ে গেলেও হয়নি হত্যা মামলার বিচার। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, বিচারক সংকট ও মহামারি করোনার কারণে দীর্ঘ সময়েও শেষ করা যায়নি বিচারিক কার্যক্রম। বিচার না পেয়ে স্বজনের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ স্থানীয়রাও। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কঞ্চিবাড়ি, বেলকা, দহবন্দ, হরিপুর, বামনডাঙ্গা, সর্বানন্দ, রামজীবন ও ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ-মিছিল করেন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। তারা বামনডাঙ্গা বাজার, শোভাগঞ্জ বাজার, ছাইতানতলা বাজার, বামনডাঙ্গা রেলস্টেশন, রেলের প্রকৌশল অফিস, বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-লুটপাট চালায়। উপড়ে ফেলা হয় বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনের লাইন।
সাঈদীর রায় ঘোষণার পর বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে দুর্বৃত্তরা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। একপর্যায়ে ফাঁড়ির চার কনস্টেবলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়াও আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে তার জিহ্বা কেটে ও চোখ উপড়ে মেরে ফেলা হয়।
সেদিনের জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও হত্যার ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীন উপ- পরিদর্শক (এসআই) আবু হানিফ ৯২ জনের নামে ও অজ্ঞাতপরিচয় আড়াই হাজার মানুষকে আসামি করে মামলা করেন। পরে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীন
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাম্মেল হক ২৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে গাইবান্ধা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এর মধ্যে একজন শিশুও ছিল।
নিহত পুলিশ সদস্য নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী ফিরোজা বেগম বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর পরেও স্বামী হত্যার বিচার পাইনি। কবে এই হত্যার বিচার পাব তাও জানি না। ঘটনার পর কিছু আর্থিক সহায়তা পেলেও আর কেউ খবর রাখেনি আমাদের। এই হত্যা মামলার বিচার কাজ শেষ করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। শিগগিরই বিচারের মাধ্যমে স্বামীর হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে
নিহত অপর পুলিশ সদস্য হযরত আলীর স্ত্রী লায়লা বেগম বলেন, হত্যাকারীদের কেউ পলাতক কেউ বা জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ আমাদের প্রতিটি দিনই কাটছে চোখের জল মুছে। একমাত্র শিশু সন্তান ইফতেখার আজ বাবা হারা। ১০ বছরেও বিচার না পাওয়ায়
হতাশা বাড়ছে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম রাসেল বলেন, চার পুলিশ হত্যার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশ হত্যা মামলা বিচার কাজ এখনো শেষ হয়নি। আসামিরা লিয়াজু করে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছেন। শুনেছি মামলার অনেক সাক্ষীই নানা অজুহাতে আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না। এ কারণে বিচার শেষ হতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তবে আলোচিত এই মামলার বিচার কাজ দ্রুত নিস্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীগ্রহণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
চার পুলিশ হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক প্রভাষক আব্দুল্লাহ আল মেহেদী রাসেল বলেন, আমি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছি। মামলার সাক্ষী হওয়ায় বিভিন্ন হুমকিতে রয়েছি। আমাকে কয়েকবার হত্যার হুমকিও দিয়েছে। এখন
আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেরাচ্ছে। এমনকি অনেক আসামি ইউপি চেয়ারম্যানও হয়েছেন। আশা করি দ্রুত সময়ে মামলার বিচারকার্য শেষ হবে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ প্রিন্স
বলেন, চার্জশিট দেওয়ার পর মামলাটি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত থেকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। বদলিজনিত কারণে গত দুই থেকে তিন বছর আদালতে বিচারক ছিলেন না। এছাড়াও মহামারি করোনার কারণে মামলার বিচারকাজ
পিছিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এই মামলার ৭৪ সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে ২২৯ জনকে গ্রেফতার করা হলেও তারা সবাই জামিনে মুক্ত। জামিনে মুক্তদের মধ্যে দুইজন পলাতক রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলাকালে ৮ আসামির মৃত্যু
হয়েছে। প্রথম থেকেই ৬ আসামি পলাতক থাকায় তাদেরকে গ্রেফতার করা যায়নি। আশা রাখছি দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তি হবে। সেইসঙ্গে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।
এবিষয়ে গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার মো. কামাল হোসেন বলেন, মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদস্যরা আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। আমরা মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য আদালতের সরকারি আইনজীবীর সঙ্গে নিয়মিত
যোগাযোগ রাখছি। আশা রাখি দ্রুত সময়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষের মাধ্যমে চার বীর পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হবে।
এদিকে, স্থানীয়রা এই দিনটিকে ‘সুন্দরগঞ্জ ট্র্যাজেডি’র দিবস হিসেবে স্মরণ করে আসছে। নিহতদের স্মরণে প্রতি বছরই স্বজন ও স্থানীয়রা শোক র্যালি, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন।