শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৪
11 Nov 2024 03:33 am
৭১ভিশন ডেস্ক:- শেখ হাসিনার সরকার পতনের চার দিন পর গতকাল শুক্রবার সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় থানা পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সকাল থেকে রাজধানীর প্রায় ২৯টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়। এ ছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী ২১ থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং বাধ্য হয়ে দেশত্যাগের পর পুলিশের ওপর হামলা, থানায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় থানা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়া বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেননি। এ কারণে পুলিশের মধ্যে এখনো সার্বিকভাবে শৃঙ্খলা ফেরেনি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত থানায় চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসার জায়গাও নেই। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে।
দেশে বেড়েছে হামলা, লুটতরাজ, ডাকাতি, সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পরিকল্পিত হত্যাসহ নানা অরাজকতা।
সূত্র বলছে, সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশে ৬২৫টি থানার মধ্যে ৪৫০টি থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি থানা থেকে বেশির ভাগ অস্ত্র লুটে নিয়েছে হামলাকারীরা। কিছু অস্ত্র রয়ে গেছে কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছে।
আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যরা বলছেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলায় সারা দেশে এ পর্যন্ত শতাধিক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন মাঠ পর্যায়ের বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য। তাঁদের অনেকে এখনো রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি। অনেকে অস্ত্রসহ নিখোঁজ রয়েছেন। এ ছাড়া বান্দরবানের একটি থানার অস্ত্রাগার থেকে সব অস্ত্র নিজেদের কবজায় নিয়েছেন আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যরা।
সূত্র বলছে, গতকাল পর্যন্ত রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগারে ৩৪০টি অস্ত্র জমা দেননি কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা। লুট হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।
খেলতে গিয়ে শিশুরা পেল অস্ত্র
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যান ৪ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাসার ছাদ থেকে একটি শটগান উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুরা খেলতে গিয়ে শটগানটি পায়। পরে সেনাবাহিনীকে খবর দিলে তারা গিয়ে অস্ত্রটি উদ্ধার করে। দুপুর সোয়া ১টার দিকে শটগানটি পাওয়া যায়।
ওই বাসার ১৪ বছর বয়সী এক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার ছোট দুই ভাই পাশের বাসার গলির ভেতরে অস্ত্রটি পেয়ে নিয়ে আসে। পরে তারা এটিকে ছাদে নিয়ে আসে। ভুলবশত ট্রিগারে চাপ লেগে একটি গুলি বের হয়। এরপর শিশুদের বাবা সেনাবাহিনীকে খবর দেন। তারা এসে অস্ত্রটি নিয়ে যায়।
সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার মো. নিজাম বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে একটি শটগান, একটি তাজা গুলি এবং একটি ব্যবহূত গুলির খোসা উদ্ধার করি।’
সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এসব অস্ত্র আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আপনাদের কাছে এখনো যদি কোনো অস্ত্র থেকে থাকে, সেগুলো আমাদের কাছে জমা দিয়ে দিন। অন্যথায় ঘোষণা আসার পর এই অস্ত্র কারো কাছে পেলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে গত বুধবার পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ সদস্যদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান। তবে আইজিপির নির্দেশ মানেননি বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য। গতকালও রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে ২৯টি ছাড়া বাকি থানার কার্যক্রম শুরু হয়নি। পুলিশ সদস্যরা বলছেন, এখনো তাঁরা নিরাপদ নন। এখনো তাঁদের মারধর করা হচ্ছে। হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
তেজগাঁও থানায় সংবাদ সম্মেলন
‘সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে দুর্বৃত্তরা যেভাবে পুলিশসহ মানুষ হত্যা করছে, তখন আমরা ডিসিশন নিয়েছি, থানা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে হবে। তাঁরা জনগণের সেবক, তাঁদের আবার রিফর্ম করার সুযোগ করতে হবে।’ গতকাল সকাল ১১টায় তেজগাঁও থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সেনাবাহিনীর ২৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কম্পানি কমান্ডার মেজর শাখাওয়াত খন্দকার। সেখানে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তেজগাঁও থানায় কয়েক শ পরিবার আছে, পুলিশ সদস্যরা আছেন। থানায় অনেক অস্ত্র আছে, যেগুলো দুর্বৃত্তদের কাছে গেলে দেশ চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তখন আমরা থানার নিরাপত্তা জোরদারের ব্যবস্থা করেছি।’
এ সময় সেখানে উপস্থিত তেজগাঁও থানার উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে আমাদের পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন, মানুষের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আজ আমরা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় পুলিশের সব কার্যক্রম শুরু করেছি।’
তেজগাঁও বিভাগে ছয়টি থানার মধ্যে তিনটি থানার কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হয়েছে জানিয়ে পুলিশের উপকমিশনার আজিমুল হক বলেন, গণ-আন্দোলনে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে যে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, তা পুনর্গঠনে কাজ শুরু হয়েছে।
এর আগে থানার কার্যক্রম শুরুর আগে তেজগাঁও থানা পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করেছে সেনাবাহিনী। সাধারণ মানুষ থানার কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান মেজর শাখাওয়াত খন্দকার।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘কিছুদিন আগেও আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি। আজ আমাদের অনেক পুলিশ সদস্য আমাদের কাছে নেই। অনেকে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। আমাদের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জন্য আমরা অনেক ভুল করেছি। আসলে আমরা জনগণের সেবক। জনগণই আমাদের মূল। আপনারা থানায় আসুন। আপনাদের সেবার জন্য আমরা প্রস্তুত রযেছি।’
অন্তত চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ শুরুর নির্দেশ
যত দ্রুত সম্ভব থানায় বসে কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন কমিশনার মো. মাইনুল হাসান। অন্তত চেয়ার ও টেবিলে বসে মানুষকে সেবা দেওয়ার কাজ অতি দ্রুত শুরু করতে বলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার ডিএমপি সদর দপ্তরে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় এই নির্দেশ দেন তিনি।
সভায় সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অপরাধ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এবং ডিএমপির থানাগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সীমান্তবর্তী ২১ থানার কার্যক্রম শুরু
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রংপুর ও যশোর রিজিয়নের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রংপুর রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১১টি থানা এবং খুলনা রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১০টি থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এই তথ্য দেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিজিবির নিরাপত্তায় এরই মধ্যে রংপুর রেঞ্জের সীমান্তবর্তী দিনাজপুরের হাকিমপুর থানা, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম থানা, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর থানা, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া থানা, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী, রৌমারী, চর রাজিবপুর, কচাকাটা, ঢুষমারা থানাসহ ১১টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্যদিকে খুলনা রেঞ্জের সীমান্তবর্তী যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানা, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, দেবহাটা ও কলারোয়া থানা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ও জীবননগর থানা, মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী থানা এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানাসহ মোট ১০টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
নওগাঁয় সব থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক
নওগাঁয় গতকাল সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে টহল কার্যক্রম শুরু করেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে পুলিশকেও টহল দিতে দেখা গেছে।
নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক বলেন, নওগাঁয় পুলিশের ওপর আক্রমণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ জন্য কর্মরত কোনো পুলিশ সদস্যই তাঁদের স্টেশন ছেড়ে যাননি। থানায় জিডিসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ চলমান ছিল। বর্তমানে কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ছুটি ছাড়া জেলার ১১টি থানায় কর্মরত প্রায় এক হাজার ৪০০ পুলিশ সদস্যই দায়িত্ব পালন করছেন।