বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫
13 Mar 2025 11:55 am
![]() |
৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ কমান্ড কাউন্সিল স্থাপিত হয়।সেসব অফিসের সাইনবোর্ডে একটি লোগো রয়েছে।একজন মুক্তিযোদ্ধা একটি বেয়নেটধারী রাইফেল ধরে দাড়িয়ে আছেন।নিচে লেখা রয়েছে- সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তি বাহিনী।দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শাসককুল ক্ষমতার স্বার্থে তাদেরকে ব্যবহার করার কারণে তাঁরা সদা জাগ্রত থাকতে পারেন নি।কমান্ড কাউন্সিল শাসকদের দুর্নীতি,অনিয়ম ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে- এমন ঘটনা চোখে পড়ে নি।কিন্তু নতুন প্রজন্ম একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে থেমে থাকে নি।ধর্ষনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিক্ষোভ করে প্রমাণ করেছে- তারা সদা জাগ্রত।
গত ৬ মার্চ মাগুরা জেলা শহরে ৮ বছর বয়সী আছিয়া নামে এক কিশোরী ভগ্নিপতির বাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়।মেয়েটিকে ধর্ষণ শেষে হত্যার চেষ্টা করা হয়।মেয়েটিকে মরণাপন্ন অবস্থায় বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।ঘটনাটি সামাজিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করতে থাকে। তাদের সাথে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। আছিয়া ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উত্তাল অবস্থা বিরাজ করছে । যদিও আগে থেকেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও দেশের বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের প্রতি যৌন নির্যাতনসহ মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদত্যাগ ও ১৫ দিনের মধ্যে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া সহ ৯ দফা দাবি পেশ করেছে।নতুন রাজনৈতিক দল 'এনসিপি' বলেছে- নারীর প্রতি সহিংসতা জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিরোধী।ইতোমধ্যে ঘটনায় জড়িত ৪ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আছিয়ার মা বলেছেন- অভাবের তাড়নায় সে তার ১৪ বছর বয়সী ১ম মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়।আছিয়া দ্বিতীয় মেয়ে।প্রথম মেয়ে এর আগে নালিশ করেছিল, তার শ্বশুর তাকে যৌন নিপীড়ন করে।আছিয়া তার বোনের বাড়িতে যেতে চায় নি।তিনি জোর করে মেয়ের বাড়িতে আছিয়াকে পাঠিয়েছিলেন।সেজন্য তার দুঃখের শেষ নেই।বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দাবি উঠেছে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার।কেউ কেউ প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবি তুলেছে।
এরকম ঘটনা ও এরকম শাস্তির দাবি এবারই প্রথম নয়। আধুনিক বিশ্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োগ দেখা যায় না। সৌদি আরবসহ কয়েকটি কর্তৃত্ববাদী দেশে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ রয়েছে।শাস্তি সাধারণত চার প্রকার; দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, প্রতিশোধমূলক শাস্তি, প্রতিরোধমূলক শাস্তি ও সংশোধনমূলক শাস্তি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থেও বিভিন্ন শাস্তির কথা বলা আছে৷যেমন-মনু সংহিতায় চার ধরণের শাস্তির কথা বলা আছে ;যথা- বাকদন্ড(উপদেশ), ধিক দন্ড(নিন্দা), ধন দন্ড( জরিমানা), বধ দন্ড( মৃত্যুদণ্ড)। ইসলাম ধর্মেও অনুরূপ শাস্তির কথা বলা আছে; দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সংশোধনমূলক শাস্তি, প্রতিশোধমূলক শাস্তি ও ইনসাফ ভিত্তিক শাস্তি ( স্থানাভাবে ব্যাখা দেয়া হলো না)।
যখন কোনো অপরাধ ভয়াবহ ভাবে ঘটতে দেখা যায়, প্রচলিত আইনে ঠেকানো সম্ভব হয় না, তখনই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োগ করা হয়( দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সকল সময়ে বহাল থাকলে প্রমাণ হয়, দেশের মানুষ সংশোধন হচ্ছে না)। প্রতিশোধমূলক শাস্তি হলো অপরাধের সমানুপাতিক শাস্তি। জীবনের বদলে জীবন,চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত ইত্যাদি।প্রতিরোধমূলক শাস্তির বেলায় বলা আছে- যে ব্যক্তি সমাজের জন্য বিপজ্জনক। সাজা ভোগ করার পরে মুক্তি পেলে অনুরূপ অপরাধ করতে পারে, সেসরকম ব্যক্তিকে এ আইনে আটক রাখা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, নরওয়ে ২০১১ সালের ২২ জুলাই এন্ডার্স বেহরিং ব্রেইভিক ৭৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আহত করে। সেদেশে মৃত্যুদণ্ড না থাকায় তাকে এ আইনে ২১ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। সংশোধনমূলক শাস্তিতে অপরাধীকে সংশোধন ও পুনর্বাসনের কথা বলা আছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে সংশোধন মূলক শাস্তির প্রয়োগ বেশি( এদেশের কারাগারগুলোকে সংশোধনাগার নাম দেয়া হয়েছে)। এ শাস্তির দর্শন হলো- অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দেয়া সমাধান নয়। রাষ্ট্রের কাজ হলো অপরাধ করার কারণ সমুহ দুর করা। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষ বিভিন্ন কারণে অপরাধ করে থাকে।
যেমন- যখন অপরাধ করে ধরা পড়ার ঝুঁকির চেয়ে অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সুবিধা বেশি দেখে, তখন সে অপরাধ করে।যখন অপরাধের মাধ্যমে অন্যকে সুবিধা পেতে দেখে, তখন সে অপরাধ করতে উৎসাহী হয়। আবার কেউ কেউ অপরাধের জিনগত প্রস্তুতি নিয়ে জন্মায়।কারোর মস্তিস্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে সে সহজেই আক্রমণকারী ভুমিকায় নেমে পড়ে।
তাছাড়া সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলে এবং ধর্মীয় মুল্যবোধ,নৈতিক মুল্যবোধ, সাংস্কৃতিক মুল্যবোধ সর্বোপরি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হারালে মানুষ অপরাধ প্রবণ হয়ে পড়ে।সেসঙ্গে রয়েছে পারিবারিক শিক্ষা,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার অভাব। এসব শিক্ষার অভাবে মানুষ প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা।তাদের কাছে মেয়েরা যৌনবস্তু ছাড়া অন্য কিছু নয়।
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন শাসন পদ্ধতি এসেছে৷তার মধ্যে মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনকেই বেশি পছন্দ করে। কল্যাণকর রাষ্ট্র সমূহে অপরাধ কম হওয়ায় কোনো কোনো কারাগার বন্ধ ঘোষিত হয়েছে।বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি প্রাতিষ্ঠানিকতা না পাওয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব সময় অস্থির রয়েছে। এদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক। সেজন্য মোবাইল ফোনের সুবিধাও বেশি। আমরা জানি ৯৯৯ ফোনটি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা এবং অপরাধীকে ধরার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য '১০৯৮- শিশু সহায়তা ফোন' নামে একটি ফোন কল চালু আছে।কিন্তু কম পরিবারই এ সেবা সম্পর্কে অবগত আছেন।আছিয়াকে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পুলিশের হেড কোয়ার্টার তিনটি হট লাইন খুলেছে( ০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২, ০১৩২০০০২২২২)। হটলাইনগুলো খোলার প্রথম দিনেই ১০৩টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে।তবে হটলাইনের নম্বরগুলো সহজ করা উচিত। যেমন-১১১, ২২২,৩৩৩,৪৪৪, ৫৫৫ ইত্যাদির মতো হলে সহজেই শিশু-কিশোররা ব্যবহার করতে পারবে।সেসঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় সরকারকে এ সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।কল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রতিনিধি, কর্মচারি ও গ্রাম পুলিশকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।প্রতিটি স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে শারীরিক শিক্ষা নামে একটি সাবজেক্ট রয়েছে। কিন্তু কতিপয় ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের ভয়ে অধিকাংশ স্কুল মেয়েদের এ শিক্ষা দিচ্ছে না।
উন্নত বিশ্বে কেউ যদি অপরিচিত শিশু-কিশোরকে আদর করতে চায়, তাহলে আঙুলের ডগা কিংবা মাথায় হাত দিয়ে আদর করলে দোষ হিসেবে দেখা হয় না৷ সেসব দেশে এ আইন দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসেছে।মেয়েদের কথা মেয়েদের বলার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন জরুরি।সিডিএলজি' দীর্ঘদিন যাবৎ সমহারে -সমগুরুত্বে নরনারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের কথা বলে আসছে।
প্রথমে আইন পরিষদে তাদেরকে সমহারে নির্বাচিত করতে হবে এবং স্থানীয় সরকারে সংসদ সৃষ্টি করে সেখানেও সমহারে প্রতিনিধিত্ব করার ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি কোনো মেয়ে যেন যৌন নিপীড়নের কথা গোপন না রাখে এবং গোপন রাখার দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
লেখক:গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।