শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪
25 Nov 2024 09:02 am
৭১ভিশন ডেস্ক:- বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় ৩২ শিশুসহ ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ।শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর ‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আন্দোলন ও অস্থিরতার বিষয়ে প্রাথমিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম ও আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ৬০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৪০০ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
এরপর ৫ ও ৬ আগস্ট নতুন মাত্রার প্রতিবাদে প্রায় ২৫০ জন নিহত হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। অর্থাৎ ১৬ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত ২২ দিনে ৬৫০ জন নিহত হওয়ার তথ্য মিলেছে।
ছাত্র আন্দোলন
অব্যাহত অবনতিশীল পরিস্থিতি ও ছাত্র-জনতার ঢাকামুখী লং মার্চের মধ্যে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এরপর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিশোধমূলক হামলায় নিহতের সংখ্যা কত, তা জানা যায়নি। ৭ ও ১১ আগস্টের মধ্যে বেশ কিছু নিহতের তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলোর মধ্যে সংঘাতে আহত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন থাকার সময় মৃত্যুবরণকারীরাও আছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে বিক্ষোভকারী, পথচারী, সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও আছেন।
কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী ও পথচারী আহত হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে রোগী উপচে পড়েছিল।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম হতে পারে। ইন্টারনেটসেবা বন্ধ ও কারফিউয়ের কারণে চলাচলে বিধি-নিষেধ থাকায় তথ্য সংগ্রহ বিঘ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া হতাহতের বিষয়ে তথ্য দিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হাসপাতালগুলোকে বাধা দিয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রধান ও মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টার্ক গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে যে রূপান্তর ঘটছে তা মানবাধিকার, অন্তর্ভুক্তি ও আইনের শাসনকে গুরুত্ব দিয়ে শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। তিনি সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী সবার জবাবদিহির ওপর জোর দেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন মোকাবেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর অপ্রয়োজনে ও মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে। এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত হওয়া দরকার। এ ছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যা, যত্রতত্র আটক, গ্রেপ্তার, গুম ও দুর্ব্যবহার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ জমায়েতের অধিকারচর্চা লঙ্ঘিত হওয়ারও জোরালো অভিযোগ আছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, গত ৫ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের পর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সদস্যদের ওপর হামলার পাশাপাশি সাবেক ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের সদস্যরা প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব এবং আরো প্রাণহানি, সহিংসতা ও প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টার্ক বলেন, ১৫ আগস্ট বাঁশের লাঠি, লোহার রড ও পাইপ দিয়ে লোকজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকদের ওপর হামলা চালায় বলে জানা গেছে। সেদিন সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করা হয়েছে এবং ছবি তোলা থেকে বিরত থাকার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বল প্রয়োগের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। তাদের অবশ্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ যেকোনো প্রতিশোধমূলক বা প্রতিশোধমূলক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হবে।
হাইকমিশনার বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, ধর্মীয় নেতা এবং অন্যান্য ব্যক্তির উদ্যোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় স্থানগুলো রক্ষায় গ্রুপ গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানান।
ভলকার টার্ক বলেন, যাঁরা অপ্রয়োজনীয় ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বল প্রয়োগ করেছেন বা আদেশ দিয়েছেন তাঁদেরসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী সবাইকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কার্যকর প্রতিকার করতে হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান গুম ও নির্বিচারে আটক কিছু ব্যক্তিসহ হাজার হাজার বন্দি এবং দীর্ঘ মেয়াদে আটক থাকা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা ও অন্য যেকোনো খাতে নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি পদ্ধতি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ সপ্তাহে ঢাকায় আসছে জাতিসংঘ দল
মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, এ সপ্তাহেই একটি দল ঢাকা সফর করবে। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারকে কোন কোন খাতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তর সহযোগিতা করবে, ওই খাতগুলো চিহ্নিত করা এই সফরের লক্ষ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের পদ্ধতিগুলো নিয়েও তারা আলোচনা করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত বুধবার ফোনালাপের কথা উল্লেখ করে ভলকার টার্ক বলেন, বাংলাদেশের সবার মানবাধিকারকে এগিয়ে নেওয়া ও অন্তর্ভুক্তির দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সফল অগ্রযাত্রায় সহায়তা করতে জাতিসংঘ অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘ বাংলাদেশের জনগণের প্রতিও সহমর্মিতা জানায়।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অধ্যায়ে গত জুনের মাঝামাঝি হাইকোর্টের একটি আদেশের পর ছাত্রদের অসন্তোষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ক্রমান্বয়ে গতি পাওয়া ছাত্র আন্দোলন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য, আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগকে ব্যবহার, র্যাব ও বিজিবির ভূমিকাসহ বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। এ ছাড়া আন্দোলনের সময় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুরের কথাও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুতে শান্তিপূর্ণই ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলার পর থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৬ জুলাই বলেছিলেন, তিনি শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেননি। তাঁর বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনের জন্য ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের’ দায়ী করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভ আরো উসকে দেয়। তখন শিক্ষার্থীরা দেশজুড়ে আন্দোলনের ডাক দেয়।
শিক্ষার্থীদের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ জুলাই নাগাদ রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পেতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। বিএনপিসহ বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও গোষ্ঠীর সমর্থন এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে শিক্ষার আরো সুযোগ, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দাবিতে রূপান্তরে ভূমিকা রাখে। এরপর আদালত মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি এবং ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করলেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। ৩১ জুলাই তৎকালীন সরকার জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে। ১ ও ২ আগস্ট আবার আন্দোলন শুরু হয়। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সে সময় পুলিশের অনেক সদস্যকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ নিতে দেখা যায়। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল নিরপেক্ষ।
‘মার্চ টু ঢাকা’ ও সরকারের পতন
৪ আগস্ট দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি এবং সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান তিন দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কারফিউ উপেক্ষা করে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
৫ আগস্ট কয়েক হাজার লোক শহীদ মিনার অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়। প্রবল বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এরপর আন্দোলনকারীরা গণভবনে প্রবেশ এবং প্রধান বিচারপতির বাসভবন ভাঙচুর করে। তারা আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন দেয়, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করে। সরকার পতনের পরপর অনেক স্থানে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তথ্য পাওয়া যায়।
মানবাধিকারের ক্ষেত্রে উদ্বেগ
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয়ে উদ্বেগের কথা উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হলো অপ্রয়োজনে ও মাত্রা অনুপাতহীন বল প্রয়োগ ও বিচারবহির্ভূত হত্যা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার, ইন্টারনেট বন্ধসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিধি-নিষেধ এবং চলাচলে বিধি-নিষেধ।
সুপারিশ
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে আর হতাহতের ঘটনা না ঘটাকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিরোধী পক্ষের ওপর হামলা থেকে বিরত থাকতে তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে বলেছে। এ ছাড়া প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মোকাবেলায় বিজিবি, র্যাবকে মোতায়েন না করার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ। এসব বাহিনীর কার্যক্রম পর্যালোচনা করতেও অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ।
সংঘাত-সহিংসতার সিসিটিভি ফুটেজসহ সব আলামত সংরক্ষণ করতেও জাতিসংঘ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কালের কণ্ঠ