সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪
24 Nov 2024 03:14 am
নরনারী কাম তাড়নায় তাড়িত হয়ে কাঙ্ক্ষিত মনের মানুষটি পাওয়ার জন্য যে সাধনা করে-তাহাই প্রেম। নরনারীর প্রেম কাহিনী নিয়ে পৃথিবীতে বহু গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমা আছে।শুধু মানুষের বেলাতেই নয়, পশু-পাখির ক্ষেত্রেও প্রেম দেখা যায়। তাই প্রেম পবিত্র ও শ্বাসত। কিন্তু বাঙালির জীবনে প্রেম এসেছে বহু বিলম্বে।
বলা যায়, বৃটিশ শাসন আসার পর যখন এদেশের মানুষ শিক্ষিত হওয়া শুরু করে, তখন তারা প্রেমের মর্মার্থ উপলব্ধি করে। বিশিষ্ট গবেষক গোলাম মুরশিদের"হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি" নামক গ্রন্থে বিয়ের সংজ্ঞায় বলা আছে-'পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, তার মানে পুত্রের আশায় বধু গ্রহণ।'আবার, যে সমাজে চারটে বিয়ে করার ব্যবস্থা আছে, সেখানে প্রেম কোথায়!
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার আগে কুলিন থেকে নিম্ন শ্রেণী পর্যন্ত সকলের বিয়ে হতো শিশু বয়সে,তথা কামভাব আসার বহু পুর্বে। ফলে তাদের মনে প্রেমের অভাব থেকে যায়।বিয়ের পর নববধুর সঙ্গে প্রেম করা কোনো মজার বিষয় নয়।কাজেই বিধবা,পরস্ত্রী কিংবা ভাবীর সঙ্গে প্রেম করো। যাদের টাকা ছিল, তারা বাঈজী খানায় গিয়ে প্রেম খুঁজতো। সেকারণেই হয়ত মধ্যযুগে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এতো মধুর ছিল।আধুনিক ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় নিজে ১১ বছর বয়সে পঞ্চম বয়সী এক নাবালিকাকে বিয়ে করেন।তিনি প্রেম কি,সেটা যৌবন বয়সে পান নি ;সেজন্য উপন্যাসে সাবালক বয়সী মেয়েদের মাঝে প্রেম খুঁজেছেন।সেখানেও তিনি নায়িকাদের বিদ্যমান সমাজ থেকে নিতে সাহস পান নি। কপালকুণ্ডলা বড় হয়েছিল সমাজ থেকে দুরে জঙ্গলে কাপালিকের ঘরে।
বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইলে কুন্দনন্দিনী ও রোহিণী ছিল বিধবা। রজনী ছিল অন্ধ।রবীন্দ্রনাথও ভয়ে ছিলেন।তিনি ২২ বছর বয়সে ৯ বছর বয়সী মৃনালিনী দেবীকে বিয়ে করেন।বিয়ের আগে মৃনালীনিকে দেখেন নি। কোনো বোঝাপড়াও হয় নি। ফলে তিনিও প্রেম পান নি। তাঁর লেখায় প্রেম ছিল নিতান্তই রোমান্টিক।তাঁর প্রেম ছিল নিষ্কাম, তথা দেহ বর্জিত। তিনি প্রেম ছড়িয়ে দিয়েছেন আকাশে বাতাসে,ভূমিতে নয়।
এ বিষয়ে নজরুল ছিলেন দুঃসাহসিক( হয়ত পুর্ববর্তীদের লেখায় অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন)।তিনি ৫/৬ টি প্রেম করে রেকর্ড ভেঙেছেন। বাঙালি মুসলিম পরিবারের প্রথম নারী গ্রাজুয়েট ছিলেন বেগম ফজিলুতুন্নেছা জোহা(পরে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ)।কবি নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে।
নজরুল প্রেম নিবেদন করলে তিনি প্রত্যাখান করেন। শুধু তাই নয়, তিনি নজরুলের বিরুদ্ধে ভিসির কাছে নালিস দেন।ভিসি নজরুলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করেন।কবি আক্ষেপ করে বলেন-"ছেলেরা বলে আমি না কি নারী বিদ্বেষি। আর নারীদের কাছে গেলে নারীরা বলে আমি না কি নারী লোভী"।এখানে উল্লেখ্য,যেসকল কবি-সাহিত্যিকরা শিশু ও কিশোরীদের নায়িকা করে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন তাদেরকে এন সি চৌধুরী( নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী) তুলোধুনো করেছেন। সেজন্য কলকাতার কবি-সাহিত্যিকরা তাঁকে একঘরে করে রাখেন।তবে মাত্র ৬০/৭০ বছরের ব্যবধানে বঙ্গদেশে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে যুবক যুবতিরা প্রেম বিষয়ে যথেষ্ট স্বাধীন।
বিয়ের আগে পিতা মাতা তাদের পুত্র-কন্যাদের কাছ থেকে মতামত নেন।তারপরেও প্রেমের কারণে বহু দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এখন প্রায় সকলের হাতে টাচ ফোন।ফেসবুক, ইমো, ইনবক্সে চ্যাটিং ইত্যাদির মাধ্যমে সহজেই একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু যথাযথ যৌনশিক্ষা তথা সাংস্কৃতিক শিক্ষা না থাকায় বহু অপরাধ জনিত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।এখানে সম্প্রতি পাবনা শহরের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। দুই সন্তানের জননী তার দাদার বয়সী( প্রায় ৭০ বছর)এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে পরকিয়া শুরু করে।
একদিন বাসায় ডেকে তার সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে এবং বৃদ্ধের নগ্ন ছবি তুলে ৭০ হাজার টাকা আদায় করে। বৃদ্ধও ক্ষমা চেয়ে কোনো রকম পালিয়ে যায়(বৃদ্ধ বলা ঠিক নয়, বলা উচিত ৭০ বছর বয়সী যুবক)।কিন্তু পরে ওই মেয়ে আবার ফোন করে ৭ লাখ টাকা দাবি করে। তা নাহলে ফেসবুকে ভাইরাল করার হুমকি দেয়।
এবার বৃদ্ধ মানুষটির মনে সাহসের উদ্রেক ঘটে।তিনি নিকটাত্মীয় একজন পুলিশ অফিসারকে ঘটনাটি খুলে বললে থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।বর্তমানে ওই নারী হাজতে আছেন।এ বিষয়ে বাউল সম্রাট লালনের শিক্ষা আমরা নিতে পারি।তিনি বলেছেন-' মন দিয়ে দেহকে নিয়ন্ত্রণ করো, দেহ দিয়ে মনকে নয়'।
লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।