মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৩
03 Dec 2024 11:36 pm
শাফায়াত সজল ভারতের গঙ্গারামপুর থেকে ফিরেঃ- ইতিহাসের পাতা অন্যতম এক যোদ্ধা হলেন ইখতিয়ার মোঃ বখতিয়ার খলজি বা খিলজী। যিনি বাংলার লক্ষণ সেনকে পরাস্ত করে প্রথম বাংলা দখল করে। বাংলা ও বিহার অঞ্চলে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এই তুর্কি সেনাপতি ও বীরযোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। তিনি ছিলেন তুর্কি জাতি ভুক্ত খিলজি বংশের সন্তান। বখতিয়ার খিলজির পূর্বপুরুষ আফগানিস্তানের গরমশির অঞ্চলে বাস করতেন। খুবই অল্প বয়সে তিনি ভাগ্যান্বেষণে বের হন এবং বহু দরবার ঘুরে অযোধ্যার শাসক হুসামুদ্দিন এর সেনাবাহিনীতে স্থির হন।
নবাব হুসামুদ্দিন তাঁকে ❝ভগবত❞ ও ❝ভিউলা❞ নামক দুটি পরগনার জায়গীর দান করেন। এরপর থেকেই তাঁর জীবনধারা বদলে যায় এবং নিজেকে একজন সুশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান। একজন দক্ষ, যোগ্য শাসক ও সেনাপতি হিসেবে বখতিয়ার খিলজির সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে দিল্লির শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেক এর সুদৃষ্টি লাভ করেন এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করার বিনিময়ে বিহার অভিযানের অনুমতি পান। বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার খিলজির ক্ষমতা এবং সামর্থ্য আরো সংহত ও দ্বিগুণ হয়।
তিনি বিশাল এক সৈন্যবাহিনী গঠন করেন এবং ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা লক্ষ্মণসেন'র শাসনাধীন বাংলার নদীয়া জয় করেন। এমন আকস্মিক আক্রমণের জন্য লক্ষ্মণসেন তার প্রধান রাজধানী বিক্রমপুর ছেড়ে পালিয়ে যান। আর এভাবেই বাংলার মাটিতে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। এরপর তিনি ধীরে ধীরে লক্ষ্মণাবতী, গৌড় সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ বিজয় করেন। লক্ষ্মণাবতীর নাম বদলে লখনৌতি করে তাকে রাজধানী ঘোষণা
করেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মোঃবখতিয়ার খিলজি তিব্বত অভিযান বের হন। কিন্তু উপজাতিদের বিশ্বাসঘাতকতা, কূটকৌশলের কাছে পরাস্ত হন। এতে তাঁর সেনাদলের বৃহদাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। তিব্বত বিপর্যয়ের পর ব্যর্থতার গ্লানি, শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তৎকালীন দেবকোটে (বর্তমান দিনাজপুর) ফিরে আসেন। এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবে কেউ কেউ বলেন তিনি মীর মর্দানের হাতে নিহত হয়েছেন।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারখিলজি নামটি ইতিহাসের পাতায় যতটা উচ্চারিত ঠিক ততটাই বর্তমান সময়ে অবহেলিত ও অজ্ঞাত বখতিয়ারের সমাধিস্থল। বখতিয়ার খিলজির কবর যে এখনো চিহ্নিত আছে তা হয়তো বহু মানুষের অনেকেরই জানা নেই। বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বখতিয়ার খিলজি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় নিরবে ঘুমিয়ে আছেন। উক্ত জেলার গঙ্গারামপুর থানার পীরপালে এখনো টিকে আছে তাঁর বিলুপ্তপ্রায় সমাধিসৌধ। অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের দাঁরপ্রান্তে মোঃ বখতিয়ার খিলজির সমাধিসৌধ। সমাধিস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে বারো দুয়ারি এবং দীঘির ঘাট এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ধসে গেছে সমাধিসৌধের দেয়াল এর একাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, বারো দুয়ারি নামে চিহ্নিত স্থাপনাটি মূলত একটি মসজিদ ছিল।
মসজিদের মুসল্লি ও কবর জিয়ারতকারীদের অজুর জন্য সাদাপাথর বাঁধানো ঘাট তৈরি করা হয়েছিল। লোকমুখে শোনা যায়, সমাধি ও বারোদুয়ারি পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল।
তবে ব্রিটিশ সার্ভেয়ার স্যার ফ্রান্সিস বুকানন হামিল্টন, যিনি ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তরবঙ্গ ও বিহারে জরিপকাজে নিযুক্ত হন। তিনি বখতিয়ার খিলজির সমাধির বিবরণ দেওয়ার সময় বারোদুয়ারির ভেতরে অন্য একটি কবর আছে বলে উল্লেখ করেছেন। স্যার হামিল্টনের ধারণা বারোদুয়ারির কবরটিই হলো বখতিয়ার খিলজির এবং এখনো টিকে থাকা কবরটি বখতিয়ারের সহচর পীর বাহাউদ্দিন এর।
অবশ্য সমাধিসৌধের সামনে টানানো বতর্মান নামফলকে স্যার হামিল্টনের ধারণাকে বিভ্রান্ত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং টিকে থাকা সৌধটিকেই বখতিয়ারের বলে দাবি করা হয়েছে। বর্তমানে কালের নিয়মে বখতিয়ার খিলজির সমাধি অবহেলার পাত্র হলেও স্থানীয় সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘দেবতুল্য’। কথিত আছে বখতিয়ার খিলজি মাটিতে শুয়ে আছেন বলে পীরপালের মানুষরা খাট বা চৌকিতে ঘুমায় না। তারা অনেকাংশে শত শত বছর ধরে মাটিতেই ঘুমিয়ে আসছে। {বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে তথ্য গুলো নেয়া হয়েছে}।