শনিবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩
25 Nov 2024 03:16 am
উজ্জ্বল রায়, জেলা নড়াইল প্রতিনিধি থেকে:-নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সৈয়দ সজিবুর আলভী (২৩) নিজের শখের ল্যাপটপ বিক্রি করে চা বিক্রির টং দোকান দিয়েছেন। কোনো কাজই যে ছোট নয় সে কথা আরেকবার প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি। উজ্জ্বল রায়, জেলা নড়াইল প্রতিনিধি থেকে জানান, সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী বাধাঁঘাটের সামনে ছোট্ট একটি টং দোকান দিয়েছেন আলভী। সেখানে কেতলি হাতে চা বানাচ্ছেন তিনি। তার দোকানে সাধারণ রঙ চা থেকে শুরু করে তান্দুরি, তেঁতুল, অপরাজিতা, কাশ্মীরি, বুলেট, বিটরুট, তুলসী, বাম্বু, মালাই ও বাদামসহ ২০ প্রকারের চা পাওয়া জায়। ৫ টাকা থেকে শুরু করে প্রকারভেদে এসব চা বিক্রি হয় ৫০ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া লেবুর পিনিক ও সুস্বাদু চিকেন মোমো বিক্রি করছেন তিনি। আর এসব খাদ্যের স্বাদ নিতে প্রতিদিন তার দোকানে ভিড় করছেন নানান বয়সী মানুষ। খাবারের মান ভালো হয়ায় সকলের প্রশংসা কুঁড়াচ্ছেন তিনি। এছাড়া আলভীর দোকানে রয়েছে ষ্টিকি নোটের ব্যবস্থা। খাওয়ার পর খাবারের মান কেমন ছিলো তা লিখে একটি বোর্ডে লাগিয়ে রাখতে পারবেন যে কেউ।
প্রতিমাসে এখান থেকে আয় করছেন প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা। যা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলছে তার পড়াশোনা। পাশাপাশি পরিবারের পাশেও দাঁড়াতে পারছেন তিনি। এদিকে, শিক্ষিত তরুণের এমন উদ্যোগকে প্রথমে কেউ ভালোভাবে না নিলেও এখন সাধুবাদ জানাচ্ছেন সবাই।
বাধাঘাটের মৌসুমী মেসে থাকা নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্স পড়োয়া সূর্য্য বলেন, আলভী আমাদের কলেজে পড়ে পাশাপাশি টং দোকানে ব্যবসা করে উপার্জনের টাকা দিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহ করে। এ জন্য আমরা তাকে অনেক পছন্দ করি।
মৌসুমী মেসে থাকা নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্স পড়োয়া আরেক ছাত্র সমিরোন বলেন, আলভীকে তিনি অনেকদিন ধরে দেখছেন। সে অনার্সের ছাত্র, পাশাপাশি সে এখানে একটি চায়ের স্টল করেছে। সে নিজে স্বনির্ভর হয়ার চেষ্টা করছে। এটা আসলে একটা ইতিবাচক দিক। তিনি মনে করেন, যারা চায় লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি না পেলে নিজে স্বনির্ভর হয়ার চেষ্টা করবেন তাদের জন্য আলভী একটা অন্যরকম উদাহরণ।
স্থানীয় বারী জানান, পরবর্তী প্রজন্মকে ব্যবসা বা নিজে কিছু করতে অনুপ্রেরণা দিবে। আমাদের দেশের জন্য একটা বড় বিষয়। এটি খুবই ভালো কাজ।
দোকানে চা খেতে আসা নড়াইল পৌরসভার কুড়িগ্রামের বাসিন্দা তনু বলেন, প্রথম থেকে তিনি এই দোকানে বসেন, আড্ডা দেন এবং খাবার খান। দোকানদার সকলের সঙ্গেই খুব ভালো ব্যবহার করেন। বর্তমান সময়ে কলেজ-ভার্সিটিতে যারা লেখাপড়া করে তারা অবসর সময় আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আলভী ভাই পড়ালেখার পাশাপাশি যে নিজে আত্ম কর্মসংস্থান গড়ে তুলেছে এটা সত্যিই প্রশংসানীয়।
দোকানে চা খেতে আসা আরেক বাসিন্দা সাকিব বলেন, এই দোকানে তিনি প্রথম অর্ডার করেছিলেন মমো। মমোটা তার খুব ভালো লেগেছে। আর আমাদের প্রত্যেকেরই উদ্যোক্তা হওয়া উচিত। আলভী ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি যেভাবে একটি দোকান চালাচ্ছে এবং নিজের পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তুলতেছে এটা একটা ভালো খবর।
তরুণ উদ্যোক্তা ও টং দোকানের মালিক সৈয়দ সজিবুর আলভী বলেন, এইচ এসসি পরীক্ষা দিয়ে নড়াইল থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন চায়নিজ ভাষা শিখতে।সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি খাবারের দোকোনে চাকরি নেন। কাজ ঠিকঠাক করলেও বেতন ঠিকমত পেতেন না। এরপর ঠিক করেন নিজেই উদ্যোক্তা হবেন। চায়ের দোকান দিবেন। তবে একথা বাড়িতে জানালে কেউ তা মেনে নেয়নি। পরিচিত কেউই তেমন ভালোভাবে নেননি। তবে কারো কথায় কান না দিয়ে নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে থাকেন আলভী। ২০২২ সালে এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে এবং শখের ল্যাপটপ বিক্রি করে দোকান শুরু করেন। এরপর লোন নিয়ে বন্ধুর ধার পরিশোধ করেন। কয়েক মাসের মধ্যে লোনটিও পরিশোধ হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে এই দোকানের আয় দিয়ে পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত খরচ মিটিয়ে পরিবারেও অবদান রাখছে আলভী। ভবিষ্যতে বড় একটি রেস্টুরেন্ট করার স্বপ্ন রয়েছে তার। বর্তমানে বেকরত্ব একটা সামাজিক ব্যাধি। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়া খুবই দরকার। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোট কিছু নিয়ে শুরু করলে সামনে ভালো কিছু করা সম্ভব। চাকরির যে বাজার তা ধরতে গেলে অনেক সমস্যা। তাই তিনি মনে করেন, যে নিজে আত্মবিশ্বাসী হয়ে, উদ্যোক্তা হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজ শুরু করলে অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু পরে সবাই সমর্থন করবে। প্রথম পর্যায়ে কেউ কারো পাশে থাকে না। তার বেলায়ও এমন হয়েছে। তাই বেকার যারা আছে তাদের কাজ শুরু করা উচিত বলেও মনে করেন তরুণ এই উদ্যোক্তা।
আলভীর এমন উদ্যোগকে সাধু বাধ জানিয়ে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান শাহাবুদ্দিন, এ প্রতিবেদক উজ্জ্বল রায়কে বলেন, এটা নিঃ সন্দেহে একটা ভালো উদ্যোগ। কারণ বর্তমান যে প্রেক্ষাপট, তাতে আসলে লেখাপড়া শিখে চাকরি বা অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ খুব কম। আর সেক্ষেত্রে আলভীর উদ্যোগ অনুকরণীয়। পরিবারের সহযোগিতা ছাড়াই নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো, সমাজ এবং পরিবারের বোঝা না হয়ে যে আত্মনির্ভরশীল হয়ার চেষ্টা করা এটা সত্যি প্রশংসার দাবিদার।