শনিবার, ২৪ জুন, ২০২৩
17 Jul 2025 03:42 pm
![]() |
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ- গাইবান্ধায় থামছেই না ছিনতাই-হত্যা, ধর্ষণ! চলতি বছরে জেলার সাত উপজেলায় তিন মাসে ছিনতাই-হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, প্রতারণা ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১১টি। ১২টি খুনের মধ্যে ইজিবাইক ছিনতাই নিয়ে হত্যা হয়েছে তিনটি এবং নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৭টি।
এদিকে ঘটে যাওয়া অপরাধেরগুলো বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হলেও জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তবে কতটা অবনতি হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। আবার সামগ্রিকভাবে সেগুলো থেকে একটা উদ্বেগজনক চিত্রও কিন্তু নিঃসন্দে দেখতে পাওয়া যায়।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জুডিশিয়াল মুন্সিখানা হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জেলায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খুনের ঘটনা ঘটেছে ১২টি, নারী-শিশু নির্যাতন ৪১টি। আর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৬ জন নারী ও শিশু। এছড়া চুরি হয়েছে ২১টি এবং রয়েছে একটি ডাকাতির ঘটনাও। এসব ঘটনায় মামলায় হয়েছে সমপরিমাণ। এছাড়া মাদকসহ অন্যান্য ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১৭ টি।
চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর মধ্যে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি দুপুরে গোবিন্দঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকার একটি পুকুর থেকে নিখোঁজের ছয়দিন পর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক কনক প্রামাণিকের (১৯) হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে সাদুল্লাপুরের ইজিবাইক চালক রাজু মিয়ার (২৮) গলাকাটা মরদেহ সদররের উজির ধরনীবাড়ি এলাকার রেল লাইনের পাশ থেকে উদ্ধার কর হয়। ২০ মার্চ সকালে সাঘাটার সিলম্যানের পাড়ার একটি ভুট্টা ক্ষেতে থেকে রুবেল মিয়া (২৪) নামে আরেক ইজিবাইক চালকের গলায় গামছা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া ২৮ জানুয়ারী সকালে সাদুল্লাপুরে বৃদ্ধ কৃষক সুরুত আলীর (৬৫) গলা কাটা মরদেহ বাড়ির পাশের নদীর ধার থেকে উদ্ধার এবং ১৮ মার্চ সদরের দুর্গাপুরে ঘাসের জমি থেকে জিসান মিয়া (১৩) নামে ৯ম শ্রেণীর এক ছাত্রের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া অপহরণের আটদিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ফুলছড়ির নিখোঁজ মিল ব্যবসায়ী সোলায়মানের (৫১) মরদেহ বগুড়ার রেল লাইনের পাশ থেকে উদ্ধার করে সান্তাহার রেলওয়ে পুলিশ।
এদিকে, ২৮ জানুয়ারি সাদুল্লাপুরে নদীর ধার থেকে কৃষক সুরত আলীর (৬৫) গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার, ৩ ফেব্রুয়ারী ফুলছড়ির নিখোঁজ ব্যবসায়ী সোলায়মানের (৫১) মরদেহ অপহরণের আটদিন পর ১১ফেব্রুয়ারি বগুড়ার রেল লাইনের পাশ থেকে উদ্ধার ঘটনায় আজও কোনো কুলু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
অন্যদিকে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পলাশবাড়িতে গভীর রাতে স্ত্রীর পরকিয়া দেখে ফেলায় সাবল দিয়ে প্রতিবন্ধী স্বামী নুরুল ইসলামের (৪৫) চোখ উপরে ফেলে স্ত্রী সাজেদা বেগম। অপরদিকে, ২৯ মার্চ স্বামীর পরকিয়ার জেরে শরীরে পেট্রোল ঢেলে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে নিজেকে হত্যা করে রোকসানা বেগম (৩৫) নামের এক গৃহবধু। ২৯ মার্চ সাঘাটায় পারিবারিক মান অভিমান থেকে গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে শিলা আক্তার (১৬) নামের তালাকপ্রাপ্তা এক কিশোরী।
অপরদিকে, ১৪ ফেব্রুয়ারি সদরের খোলাহাটিতে তিন বছরের এক শিশু ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়, পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি সাদুল্লাপুরে প্রতিবন্ধী যুবতী (২০) ধর্ষণের মামলা হয় থানায়। এর দুইদিন পর ১৭ ফেব্রুয়ারি সাঘাটায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া তিন শিশুকে যৌন নিপীড়ন করে ষাটোর্ধ বয়সী এক বৃদ্ধ। এরপর গত ২ মার্চ গোবিন্দগঞ্জে সাড়ে ৪ বছরের এক শিশুকন্যা ধর্ষণের শিকার হয়। একইদিন রাতে সাঘাটায় ধর্ষণের শিকার হয় ১২ বছর বয়সী মাদরাসায় পড়ুয়া সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। এরপর গত ১৩ মার্চ সুন্দরগঞ্জে ছাপরহাটিতে ১৭ বছর বয়সী এক তরুনীকে বিয়ের কথা বলে বাড়িতে ডেকে নিয়ে মাথার চুল কেটে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ১৩ মার্চ বিকেলে সদরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া সাত বছরের এক শিশুকন্যা। ভুট্টা ক্ষেতে নিয়ে তিন যুবক শিশুটিকে ধর্ষণ করে।
এবং সাদুল্লাপুরে গত বছরের ৭ জুলাই এক প্রতিবন্ধী (২০) ধর্ষেণের ঘটনায় চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারী থানায় একটি মামলা হয়। প্রতিবন্ধী মেয়েটি বর্তমানে সন্তান সম্ভবা। এঘটনায় অভিযুক্ত আজও ধরা ছোয়ার বাহিরে।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) এর গাইবান্ধার প্রোগ্রাম অফিসার রুহুল আমিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, " বেশিরভাগ র্ধষণের ঘটনা ঘটছে উর্তি বয়সের ছেলে মেয়েদের প্রেমের সম্পর্কর সূত্র ধরে। এছাড়া যেকোনো ধরনের প্রতিশোধ স্পৃহা, র্দীঘ সময় ধরে স্বামী বা স্ত্রী ভিন দেশে থাকায় পরকীয়া, শারীরিক অক্ষমতা এবং স্বামীর আর্থিক অক্ষমতাও ধর্ষণের উল্লেখযোগ্য কারণ। অপরদিকে, যৌতুক, দ্বিতীয় বিবাহ, ভরণপোষণ, নেশা, আত্মীয়র মধ্যে অর্থনৈতিক উচুঁ-নিচুর বৈষম্য এবং পরিবারে মেনে না নেওয়ার প্রবণতার কারণে বাড়ছে নারী নির্যাতন।
এ বিষয়ে জেলা নারীমুক্তি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী বলেন," অপরাধীদের সঠিক বিচার ও কঠিন শাস্তি না হওয়ার কারণেই সামজিক অপরাধগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধ করার পরেও অপরাধীরা যখন গ্রেপ্তার হয়না এবং অপরাধীদের যখন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়না তখন অন্যরাও অপরাধ করার সাহস পায়। ফলে দিনদিন ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গাইবান্ধা জেলা বার এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহবায়ক এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, "শুধু আইন করে সমাজ থেকে চুরি-ছিনতাই, প্রতারণা, খুন ও ধর্ষণ নির্মূল কিংবা কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। একদিকে অবশ্যই আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে, অন্যদিকে (পাবলিক এ্যাওয়ারনেস) জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, তবেই সম্ভব।
এসব বিষয়ে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মো. কামাল হোসেন মুঠোফোনে বলেন, পুলিশের বেসিক এবং ফান্ডামেন্টাল কাজই হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখা। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বের এবং পরের সকল কার্যক্রমেই জেলা পুলিশ সর্বোচ্চ আন্তরিক এবং পেশাদারী প্রচেষ্টা অক্ষুন্ন রেখেছে। এসময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো সমাজেই আসলে অপরাধ সংঘঠনের বাহিরে নয়। অন্যান্য সময়ের তুলনামূলক জেলায় ধর্ষণ এবং খুনসহ সকল অপরাধের ঘটনা কম রয়েছে। ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনায় মামলা, আসামী গ্রেপ্তারসহ সকলকর্ম সম্পাদন করছে পুলিশ। এসব অপরাধ নির্মূল কিংবা আরো কমিয়ে আনতে পুলিশের পক্ষ থেকে জনসাধারণের সচেতনতার জন্য বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে।