সোমবার, ০৮ মে, ২০২৩
22 Nov 2024 06:56 am
শাফায়াত সজল, রাজশাহীর বাঘা থেকেঃ- ভ্রমণ পিপাসুদের মন প্রায়ই ছুটে যেতে চায় প্রাকৃতিক ইতিহাস ঐতিহ্যের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনো না কোনো স্থানে। তেমনি একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায় অবস্থিত ৫০০ বছরের সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন দীঘি ও ঐতিহাসিক বাঘা শাহী মসজিদ। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন শতশত দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে মসজিদ প্রাঙ্গন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যদি পর্যটন কর্পোরেশনের আওতায় নেওয়া হলে বাঘা হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম এক পর্যটন কেন্দ্র। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আছে। সরকার প্রতি বছর এখান থেকে অনেক টাকার রাজস্বও পেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরী থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিন পূর্ব দিকে উপজেলা সদরে অবস্থিত প্রাচীন এই নিদর্শন। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের ছেলে নাসির উদ্দীন নসরত শাহ হিজরি ৯৩০ ও ১৫২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দে বাঘা শাহী মসজিদ নির্মাণের সময় জনকল্যাণার্থে দীঘি খনন করেন। প্রায় ৫২ বিঘা জমি জুড়ে দর্শনীয় বিখ্যাত সুবিশাল দীঘি ও ৫০০ বছরের ঐতিহাসিক বাঘা শাহী মসজিদ এখনো ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জনশ্রুতি আছে, কোনো এক সময়ে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য মানুষ দীঘির কিনারে গেলেই ডেকচি, থালাবাসন প্রভৃতি পানির নিচ থেকে ভেসে উঠত। সেগুলো নিয়ে অতিথি আপ্যায়ন শেষে অবার দীঘিতে রেখে যেত।
একদিন কোনো এক ব্যক্তি ওই সব জিনিস ফেরত না দেয়ার ফলে ভেসে ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। কথিত আছে, দিঘীর পানির উছিলায় বিভিন্ন বালা মুছিবত দূর হয়। ফলে হাজার হাজার মানুষ দীঘি থেকে পানি নিয়ে যান। এখনো শীত মৌসুমে এই দীঘিতে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমন ঘটে। বড় দীঘির চারপাশে সারিবদ্ধ অসংখ্য নারিকেল গাছ। পাশেই রয়েছে একটি মাজার, কেন্দ্রীয় কবরস্থান ও আমের বাগান। উত্তরে দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতি ঘেরা বিল। উত্তর-পশ্চিম কোণে জাদুঘর। তার পাশেই ইসলামী একাডেমি স্কুল কলেজ ও হাফেজিয়া মাদরাসা। তার পাশে বাঘা ঈদগাহ মাঠ। পাশেই ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ ও আরেকটি মাজার। তার দক্ষিণেই রয়েছে বাঘা ডাকবাংলো ও হাজার বছরের সেই তেঁতুল গাছ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানে কোন একসময় এশিয়া মহাদেশের একমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখান থেকে সামান্য দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে প্রমত্তা পদ্মার শাখা নদী। উল্লেখ্য শাহী মসজিদটি সম্পূর্ণ প্রাচীরে ঘেরা এবং উত্তর পাশে ১টি এবং দক্ষিণ পাশে ১টি প্রধান ফটক আছে। মসজিদটির আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৭৫ ফিট ৮ ইঞ্চি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি এবং দেয়ালগুলো ৭ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রশস্ত। মসজিদের ভেতরের মেহরাবগুলোতে রয়েছে অতি সুন্দর কারুকার্য। অত্যন্ত আকর্ষণীয় মসজিদটি টেরাকোটা অর্থাৎ পোড়া মাটির অলঙ্করণে অদ্বিতীয়। মসজিদের বাইরে এবং ভেতরে, দেয়ালে, খিলানে ও প্যানেল সর্বত্র টেরাকোটা নকশা দেখা যাবে। প্রতিটি মেহরাব একটি ফ্রেমেই আবদ্ধ।ফ্রেমের উপর ও পাশে নানা ধরনের নকশা রয়েছে। মেহরাব খিলানগুলো দেয়ালের একঘেঁয়েমি দূর করার জন্য বিভিন্ন প্যানেল সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রচলিত ৫০ টাকার নোটে এ মসজিদের ছবি মুদ্রিত রয়েছে।
দেওয়ালের গায়ে আঁকা হয়েছে আমগাছ, শাপলা ফুল ও লতাপাতার অপূর্ব কারুকাজ। মসজিদটির ওপরে রয়েছে মোট ১০টি গম্বুজ ও চারটি মিনার। ভেতরে রয়েছে ছয়টি স্তম্ভ ও সুন্দর কারুকার্যখচিত চারটি মেহরাব। মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লিখিত একটি শিলালিপি রয়েছে। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত হয়েছে একটি বিশেষ নামাজ কক্ষ। অনেকে মনে করেন, এটি আগে মহিলাদের নামাজের জায়গা ছিল। আবার অনেকের মতে, কক্ষটি সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত গভর্নরের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। মসজিদের পাশেই আছে একটি কবরস্থান। বেশ কয়েকজন বুজুর্গ শায়িত আছেন এখানে। কথিত আছে, হজরত শাহ দৌলাহ দানেশমন্দ (রহ.) পাঁচজন সঙ্গী সহ ১৫০৫ সালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে বাঘায় আসেন। তিনি খানকা গড়ে এখানেই থেকে যান এবং ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। পরে ইন্তেকাল করলে বাঘা মসজিদের এই মাজারেই তাকে শায়িত করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক এই স্থানে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসেন। দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত দৃষ্টিনন্দন স্থানটি। বর্তমান সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ইতিমধ্যে অযু খানা আধুনিকায়নের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন এবং কাজ চলমান রয়েছে। বাঘায় পর্যটন উপযোগী কিছু উদ্যোগ নিলে দেশবিদেশের হাজার হাজার পর্যটকের কাছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এবং সরকার এখান থেকে অনেক টাকার রাজস্ব আয় করতে পারে । জানা যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইতঃপূর্বে বাঘায় জনসভায় ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ, দীঘি ও মাজার এলাকাকে পর্যটন শিল্পের আওতায় আনার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের আওতায় মোটেল সহ কিছু উদ্যোগ নিলে দেশ বিদেশের পর্যটকের কাছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে রাজশাহীর বাঘা শাহী মসজিদটি।