বৃহস্পতিবার, ০৪ মে, ২০২৩
25 Nov 2024 12:06 am
শাফায়াত সজল,পাবনা থেকে ফিরেঃ- ১৮ শতকের কোনো এক সময়ে নির্মিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা তাড়াশ জমিদারবাড়ী বা রাজবাড়ী। আবার কারও কাছে তাড়াশ ভবন নামেও পরিচিত। পাবনা শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এই রাজবাড়ীটি । স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে এই ভবনটি নির্মাণ করেন তাড়াশের তৎকালীন জমিদার রায়বাহাদুর বনমালী রায়।
স্থাপত্যের দিক দিয়ে এটির সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁ রীতির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে এটি তালিকাভুক্ত করে। তার আগে ভবনটি বিভিন্ন সরকারি দফতর ও পাবনা মেডিকেল কলেজ এর ভবন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে এটি সংস্কার করা হয়েছে। ভবনটি পাবনা জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে স্থানীয়সুত্রে জানা গেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তৎকালীন আমলে পাবনার জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং নামকরা বলে পরিচিত ছিলেন তাড়াশের এই জমিদার। বগুড়া জেলার চান্দাইকোণার কাছে দেবচারিয়া বা কোদলা গ্রামে এক কায়স্থ জমিদার ছিলেন। এই জমিদারই হলেন তাড়াশের রায়বংশের পূর্বপুরুষ বাসুদেব চৌধুরী যার অপর নাম নারায়ণদেব চৌধুরী। তাড়াশের পরিবারটি ছিল পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় জমিদার। ষোড়শ শতকের শেষদিকে বাসুদেব চৌধুরী ঢাকায় নবাব ইসলাম খান এর রাজস্ব বিভাগে চাকরি করতেন। তার কাজের খুশি হয়ে নবাব ইসলাম খান চৌধুরাই তাড়াশ অঞ্চল জায়গীর দান করেন। তখন তিনি ২শত মৌজা নিয়ে এই জমিদারী সৃষ্টি করেন।
পরবর্তীতে নারায়ণদেব চৌধুরীর বংশধর বনমালী রায় এই জমিদারী প্রাপ্ত হোন। জমিদার বনমালী রায় জনহিতকর কাজ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে "রায় বাহাদুর" খেতাবে ভূষিত করা হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৪২ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আতঙ্কে জমিদার বনমালী রায় বাহাদুরের বংশধররা পাবনা শহরে নির্মিত ঐতিহাসিক এই তাড়াশ ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাবনা অঞ্চলের সর্ববৃহৎ জমিদার কর্তৃক নির্মিত অমর কীর্তি "তাড়াশ ভবন" আজও তাদের স্মৃতি বহন করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,পাবনা শহরের ভবনটি তাড়াশ রাজবাড়ী নামেও পরিচিত।
পাবনায় নির্মিত প্রাসাদ সমতুল্য ভবনটির সম্মুখ প্রাসাদ দ্বিতলবিশিষ্ট এবং চারটি বৃত্তাকার স্তম্ভ সহযোগে প্রাসাদের দ্বিতলের কক্ষ। প্রাসাদের সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে প্রবেশ ফটকটির দু’পাশে দুটি করে চারটি স্তম্ভ এবং মাঝখানে বিশাল আকৃতির অর্ধবৃত্তাকার খিলানে নির্মিত প্রবেশ পথটি। প্রধান প্রবেশপথ থেকে মূল ভবনটি ৩৫মি পশ্চিমে অবস্থিত। বিশাল জমিদারবাড়িটি প্রায় ১.৫৯৭ একর জমির উপর নির্মান করা হয়েছে। নীচে থেকে দোতলাতে উঠতে ভবনের উত্তরপাশে দৃষ্টিনন্দন কাঠের সিঁড়ি আছে। যা ভবনের ছাদ পর্যন্ত বিদ্যমান। সিঁড়ি ঘরের পাশেই রয়েছে পৃথক ২টি বাথরুম বা গোসলখানা।
তাড়াশ জমিদার বাড়িটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো এর প্রবেশপথ। ভবনটি আয়তাকৃতির এবং এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ৩০ দশমিক ৪০ মিটার (১০০ ফুট) এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ২৮ মিটার (৬০ ফুট)। চারটি কোরিনথিয়ান স্তম্ভের উপরে আকর্ষণীয় দ্বিতল বারান্দা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর ভবনের নীচের মূলকক্ষ ৮টি এবং ২য় তলাতেও ৮টি কক্ষ বিদ্যমান। এরমধ্য নীচতলার প্রধান কক্ষটিতে পিতলের পাতে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা ও ফুলের নকশায় সজ্জিত।
প্রাচীন এই ভবনটিতে মোট ৮০টি দরজা রয়েছে। যেগুলো ২ স্তর বিশিষ্ট। ১টি কাঠের এবং অপরটি কাচের। আছে ৫৩ টি জানালা। যাতে খরখড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। জমিদারবাড়িটি দেখতে আসা দর্শনার্থী আলম হোসেন জানান, আগে জমিদারবাড়িটি অবহেলায় অযত্নে পড়ে থাকলেও বর্তমানে এটি সংস্কার করে সুন্দর করা হয়েছে। শুনলাম এইখানে নাকি জাদুঘর করা হবে। তখন নির্দিষ্ট টিকিট করে আমাদের নতুন প্রজন্ম ইতিহাসের ব্যাপারে জানতে পারবে।
দেশের অনেক প্রান্ত থেকে এই রাজবাড়ীটি দেখতে এসে অনেকে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। জাদুঘর খোলা হলে সবাই পাবনার সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে পারবে। রায় বাহাদুর বনমালী রায় এর স্মৃতি নিয়ে জেগে থাকা এই জমিদারবাড়িটি দর্শনার্থীদের পদচারে মুখরিত হয়ে উঠুক এমনটায় প্রত্যাশা করেন সচেতন সকলে।