রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩
28 Nov 2024 10:41 pm
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ বাইসাইকেলের পিছনে বস্তা বেঁধে পায়ে হেঁটে সাঁকো দিয়ে আখিরা নদী পার হতে হচ্ছে তাকে। একই অবস্থা এলাকার দশ গ্রামের হাজারো মানুষের। খড়ায় বাঁশের সাঁকো আর বর্ষায় ডিঙি নৌকায় চলাচল একমাত্র ভরসা তাদের।
সরেজমিনে উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের করতোয়া পাড়া আমবাগান ঘাটের প্রতিদিনের চিত্র এমনই।
স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার ও চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে এই সাঁকোর ওপর দিয়েই সীমান্তবর্তী দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায় যাতায়াত করতে হয় ওইসব গ্রামের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষদের।
কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের জাফর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক জানান, অত্র ইউনিয়নের জাফর, মুংলিশপুর, পালপাড়া, শীলপাড়া, গনকপাড়া, হাসানখোর, রামচন্দ্রপুর, জাইতরসহ ১০ গ্রামের মানুষ আমবাগান ঘাট দিয়ে নিয়মিত চলাচল করে থাকেন। এর মধ্যে খড়ার বাঁশের সাঁকো এবং বর্ষায় ছোট্ট ডিঙি নৌকাই একমাত্র ভারসা তাদের। এলাকার স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা পাশের ঘোড়াঘাট উপজেলার শাহ ইসমাইল গাজী উচ্চ বিদ্যালয়, ঘোড়াঘাট মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ঘোড়াঘাট কেসি পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঘোড়ঘাট রাজিয়া সুলতানা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও নূরজাহানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। চলাচলে দুর্ভোগ তাদের নিত্যসঙ্গী। তবে খড়ার চেয়ে বর্ষা মৌসুমে দুর্ভোগ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।জাফর গ্রামের অন্য বাসিন্দা আম্বিয়া বেগম (৫৭) জানান, বর্ষা এলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকটা পথ নৌকায় পাড়ি দিতে হয়। ডিঙি নৌকায় করে আমবাগান ঘাটের এপার থেকে ওপার পৌঁছাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এতে নৗকা ডুবির আশঙ্কার পাশাপাশি অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে পৌঁছাতে বিঘ্ন ঘটে।
মুংলিশপুর গ্রামের রিক্সা-ভ্যান চালক শাহীন মিয়া জানান, আমবাগান ঘাট থেকে পাশের ঘোড়াঘাট উপজেলা মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। অপর দিকের আমাদের নিজ উপজেলা পলাশবাড়ীর দুরত্ব প্রায় তের কিলোমিটার। সে কারণে হাটবাজারসহ যে কোনো প্রয়োজনে সাধারণ মানুষদের এ ঘাট দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হয়। ব্যবসায়িক-কৃষি পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হতে হয়। মূল সড়ক থেকে ঘাট পর্যন্ত বালু পথ ঠেলে সাঁকোর দেখা মেলে। এরপর ঝুঁকি নিয়ে সাঁকো পারাপার হতে হয়। অনেক সময় পণ্যসহ রিক্সা-ভ্যান ডুবে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।কিশোরগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান অবু বক্কর সিদ্দিক জানান, দেশে পদ্ম সেতুর মত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও আমবাগান ঘাটে ব্রীজ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি এলাকাবাসীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ব্রীজ হলে এলাকার ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে গতি আসবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধা-৩ (পলাশবাড়ী-সাদুল্লাপুর) আসনে সংসদ সদস্য অ্যাড. উম্মে কুলসুম স্মৃতি জানান, পলাশবাড়ীর আমবাগান ও ঋষিঘাটসহ সাদুল্লাপুর উপজেলার একাধিক স্থানে সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে চেষ্টা অব্যাহত আছে। আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা নদী এখন মরুভূমি
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও পলি জমে ভরে উঠেছে গাইবান্ধার তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদী। খরস্রোতা অগভীর ভরা নদীগুলোতে পানি না থাকায় এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে নাব্যতা সংকটে প্রায় ৩৫ রুট নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে হাজারও নৌ-শ্রমিক ও জেলে সম্প্রদায়।
বিশেষ করে জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম, কঞ্চিবাড়ি, চন্ডিপুর, শ্রীপুর তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী দীর্ঘ ৫২ বছরেও ড্রেজিং এবং খনন করা হয়নি। সে কারণে তিস্তা ভরাট হয়ে এখন আবাদী জমিতে পরিনত হয়েছে। তিস্তা তার গতিপথ পরিবর্তন করে অসংখ্য শাখা নদীতে রুপ নিয়েছে। বছরে মাত্র ৬ মাস মূল নদীতে নৌকা চলাচল করে। গোটা বছর পায়ে হেঁটে পারাপার করতে হয় চরবাসিকে। একই অবস্থা সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোতে। এক সময় সুন্দরগঞ্জের পাঁচপীর, বেলকা, মীরগঞ্জ ও তারাপুর খেয়োঘাট হতে পীরগাছা, কাউনিয়া, উলিপুর, কুড়িগ্রাম, কাশিমবাজার, চিলমারি, রৌমারি, মোল্লার চর, ভূরুঙ্গামারি, দেওয়ানগঞ্জ, কামারজানি, গাইবান্ধা, সাঘাটা, ফুলছড়ি, জামালপুর, নারায়নগঞ্জ, বালাশিঘাট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ রুটে নৌ-চলাচল করত। বর্তমানে নাব্যতা সংকটে সবরুটে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তিস্তায় হাজারও নৌ-শ্রমিক ও জেলে সম্প্রদায় নৌকা চালিয়ে এবং মাছ ধরে সংসার চালাত। সেই সব জেলে ও নৌ-শ্রমিকরা এখন বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকে বাপ দাদার পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা জড়িয়ে পড়েছে।
হরিপুর চরের নৌ-শ্রমিক রিয়াজ মিয়া জানান, ১০ বছর আগে ৫টি নৌকা ছিল তার। নৌকার ব্যবসা দিয়ে সংসার চালাতেন। এখন মাত্র একটি নৌকা তার। সেটিও বছরের ৪ মাস মূল নদীতে চলাচল করে। নদী ভরে উঠায় এখন আর নৌকা চলে না। সে কারণে মাঝি মাল্লারা বেকার হয়ে পড়েছেন। নদী খনন বা ড্রেজিং করলে হয়তো তিস্তা তার গতিপথ ফিরে পাবে। নদীতে পানি না থাকায় বালু চরে পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নৌকা।
বেলকা চরের জেলে ভোলারাম দাস জানান, তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদীতে এখন আর জল থাকে না। পলি জমে নদী ভরে গেছে। নদীতে আর মাছ ধরার কোন সুযোগ নেই। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আমরা জেলেরা নদীতে আর মাছ ধরতে পারি না। সে কারণে অনেকে বাজারে মাছের ব্যবসা করছে। আবার অনেকে রিস্কা, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে।
সদর উপজেলার মোল্লার চর ইউনিয়নের বাসিন্দা খয়বর রহমান বলেন, এখানকার প্রায় ১৫ টি নেী রুটের মধ্যে অধিকাংশ রুট বন্ধ রয়েছে। আর যে কয়টি চালু আছে সে পথেও স্বাভাবিকভাবে নৌকা চলাচল করতে পারছে না। বাদামের চরের ব্যবসায়ী আনছার আলী জানান, জেলা ও উপজেলা শহর হতে কাপাসিয়া ইউনিয়নের বাদামের চরের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বিভিন্ন যানবাহনে জেলা ও উপজেলা শহর হতে মালামাল নিয়ে এসে ব্যবসা করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ঘোড়ার গাড়ি ও পায়ে হাঁটা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে চরের মধ্যে চলাচলের কোন মাধ্যম নেই। আজ থেকে ১৫ বছর আগে নৌ-রুটে মালামাল আনা নেয়া করা হত।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, তিস্তা নদীর সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে নদী ভাঙন রোধে জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ফেলা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া নদী সংরক্ষনের জন্য ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বরাদ্দে অপেক্ষায় রয়েছে। নাব্যতা সংকট দুরীকরণে নদী খনন ও ড্রেজিং এর জন্য একাধিকবার আবেদন পাঠানো হয়েছে। এটি উপর মহলের সিদ্ধানের ব্যাপার।স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী জানান, তিস্তার কড়াল গ্রাস হতে সুন্দরগঞ্জ বাসিকে রক্ষা করার জন্য জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়েছি। নদী ভাঙন রক্ষায় জিও ব্যাগ, জিও টিউব ফেলার কাজ চলমান রয়েছে। নদী সংরক্ষণে একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বরাদ্দ সাপেক্ষে কাজ শুরু করা হবে।