সোমবার, ০৬ মার্চ, ২০২৩
27 Nov 2024 10:59 pm
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার যমুনা নদীর ওপারের দুর্গম একটি চরের নাম দেলুয়াবাড়ী। উপজেলা শহর থেকে ওই চরের দূরত্ব ১০ থেকে ১১ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে স্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাতায়াত করা গেলেও শুকনো মৌসুমে পড়তে হয় বিপাকে। কখনো পায়ে হেঁটে আবার কখনো বা ঘোড়ার গাড়িতে করে যাতায়াত করতে হয় সেখানে। উপজেলার ফুলছড়ি ইউনিয়নের পূর্ব দেলুয়াবাড়ী, মধ্য দেলুয়াবাড়ী, পশ্চিম দেলুয়াবাড়ী, জামিরা, ঘরভাঙা, বাঘবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম মিলে এই চরে বাস করেন প্রায় ১৫-১৬ হাজার মানুষ।
চরাঞ্চলের মানুষদের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার ২০১৬ সালে এই চরে নির্মাণ করে একটি পাঁকা কমিউনিটি ক্লিনিক। ২০১৭ সালে ওই ক্লিনিকে জহুরুল ইসলাম নামে একজনকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে (কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার) নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তার অন্য একটি সরকারি চাকরি হওয়ায় এই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর থেকেই বন্ধ হয়ে আছে ক্লিনিকটি। গত ছয় বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে ক্লিনিকের ভেতরের আসবাবপত্র। জঙ্গলে পরিণত হয়েছে ক্লিনিক প্রাঙ্গণ। তাই স্থানীয়রা ক্লিনিকটির নাম দিয়েছেন ‘ভূতের বাড়ি।’স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রায় ৬ বছর ধরে বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০১৬ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হলেও একবছর পর থেকে নেই কোনো স্বাস্থ্যকর্মী (কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার)। যে কারণে এখানকার বাসিন্দাদের দুর্গম চর পাড়ি দিয়ে সামান্য চিকিৎসা নিতে যেতে হয় উপজেলা বা জেলা সদরে।
পূর্ব দেলুয়াবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আমিলা বেগম (৬৫) বলেন, ‘ক্লিনিকটি যখন নির্মাণ করা হয়, তখন একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসেছিলেন এখানে। ঘরের মেঝে নাকি কাঁপে, এই ভয়ে তিনি আর আসেননি। এরপর থেকেই ক্লিনিকটি ‘ভূতের বাড়ি’ নাম পরিচিতি পায়। ক্লিনিকটি রাস্তার সঙ্গে হলেও দিনের বেলাতেও সেখানে এখন মানুষ যেতে ভয় পান।’
এই চরের অপর বাসিন্দা ফাতেমা বেগম বলেন, ‘একটা করি মায়া বড়ির পাতা ৫০ টাকা। হামরা গরিব মানুষ, কয়দিন কিনি খামো। যদি এই ক্লিনিকটা চালু থাকলো হয় তাহলে তো বিনামূল্যে এগুলা পালাম হয়।’বাঘবাড়ী গ্রামের আফছার মোল্লা বলেন, ‘এ গ্রামে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী আসেন না। শুধু মাসে একবার স্বাস্থ্য সহকারীরা আসেন শিশুদের টিকা দিতে। বাড়ির নারীদের অসুখ হলে ফুলছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা গাইবান্ধা না নিলে চিকিৎসা মেলে না।’
নারীমুক্তি কেন্দ্রর সভাপতি অধ্যাপক রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে পৌঁছায় না স্বাস্থ্য কর্মীদের কারণে। তারা মাঠ পর্যায়ে না যাওয়ার কারণেই সরকারের এ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে চলেছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের কর্তারাই দায়ী।’
ফুলছড়ি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ওমর আলী বলেন, ‘প্রথম থেকেই ক্লিনিকটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ফলে এই গ্রামের সাড়ে ৩ হাজার ভোটার এবং ১০ হাজার মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসাও ঠিকঠাক পাচ্ছে না। চিকিৎসার জন্য দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে শহরে যেতে হয় তাদের।’
ফুলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজহারুল মণ্ডল হান্নান বলেন, ‘এই চরের কোনো অন্তঃস্বত্ত্বা নারীকে হাসপাতালে নিতে হলে খুব বিপদে পড়তে হয়। শুকনো মৌসুমে রাস্তা-ঘাট এবং যানবাহন না থাকায় প্রথমে জলচৌকিতে করে ৩ কিলোমিটার হেঁটে নৌকা ঘাটে নিয়ে নদী পার হয়ে তারপর অন্য কোনো যানবাহনে হাসপাতালে নিতে হয়। এতে অনেকের মৃত্যুও ঘটে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই ক্লিনিকে একজন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. রফিকুজ্জামান বলেন, ‘দেলুয়াবাড়ী ক্লিনিকটি ২০১৬ সালে নির্মিত হয়েছে। ক্লিনিকটিতে বর্তমানে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী (সিএইচসিপি) নেই। ২০১৭ সালে একজন স্বাস্থ্যকর্মী সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা রাখি খুব তাড়াতাড়ি সেখানে একজন স্বাস্থ্যকর্মী দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলায় ২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকে লোকবল আছে। দেলুয়াবাড়ী, গলনা, সিংড়িয়া ও এরেন্ডবাড়িসহ চারটি ক্লিনিক মেরামত করে লোকবল নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করা হবে।’