রবিবার, ০৫ মার্চ, ২০২৩
10 Nov 2024 05:47 am
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ দেশের উত্তরের অবহেলিত এক জনপদের নাম গাইবান্ধা। অন্যান্য জনপদের চেয়ে তুলনামূলক এ জেলা সবকিছু থেকেই রয়েছে অনেক পিছিয়ে। এখানে নেই অবসর সময়ে বসে বই পড়ার কোনো ভালো মানের পাঠাগার। শহরে দুই-একটি পাঠাগার থাকলেও সেগুলোও থাকে তালাবদ্ধ। এ কারণেই বইয়ের স্থান দখল করেছে তথ্য-প্রযুক্তি। আর তাই বর্তমানে শিক্ষার্থীদের হাতে বেশি থাকছে স্মার্টফোন। এমন কঠিন সময়ে শিক্ষার্থীদের পাঠাগারমুখী করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘বই ঘর পাঠাগার।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলার শেষ প্রান্তের একটি গ্রাম টেংগরজানী। এই গ্রামের মো. হান্নান মিয়ার ছেলে মেহেদী হাসান গাইবান্ধা সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করছেন। এই বয়সেই পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পাঠাগার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। অর্থনৈতিক দিক থেকে পারিবারিক নানা সমস্যা থাকলেও টিফিনের টাকা জমিয়ে গ্রামেই পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। আর সেই পাঠাগারের নাম দিয়েছেন ‘বই ঘর পাঠাগার।’খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালে মেহেদী টেংগরজানী গ্রামে ‘বই ঘর পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করেন। মেহেদীর এই পাঠাগারে এখন বইয়ের সংখ্যা এক হাজারের বেশি। সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, মহামানবদের জীবনী, বিভিন্ন ম্যাগাজিন, দৈনিক সংবাদপত্র, মাসিক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সসহ শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন বই আছে এখানে। মেহেদীর প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারে অনেকেই শুধু বিশ্রাম নিতে এসেও আকৃষ্ট হচ্ছেন বইয়ের প্রতি। বই ঘর পাঠাগারে যেমন শিক্ষার্থী ও উৎসাহী মানুষ বই পড়তে আসছেন, তেমনি আসছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ বিভিন্ন পেশার বই প্রেমীরা। ফলে পাঠাগারটিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে গড়ে উঠছে একধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
টেংগরজানী গ্রামের বাসিন্দারা জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এতো সুন্দর পাঠাগার হবে এবং তাতে দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যাবে, এটা আমরা ভাবিনি। পাঠাগারটি তৈরি হওয়ায় গ্রামের দৃশ্যপট অনেকটা বদলে গেছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে যে কিশোর-কিশোরীরা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতো, তাদের অনেকেই এখন এই পাঠাগারের সদস্য। পাঠাগারটি একদিকে যেমন বই পড়ার অভ্যাস তৈরি ও ধরে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে, তেমনি মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে দূরে রাখতেও মানুষকে সচেতন করার কাজ করছে। ইতোমধ্যে পাঠাগারটি শিশুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বই পড়ে জ্ঞান লাভ করছে, বিকশিত হচ্ছে তারা। এই পাঠাগারে এমন অনেক বই আছে যেগুলোর নাম কখনো শোনাই হয়নি।টেংগরজানী গ্রামের শিক্ষার্থী আফরোজা আক্তার বলেন, ‘কখনো কল্পনা করিনি আমাদের গ্রামে এতো সুন্দর পরিপাটি একটি পাঠাগার হবে। এখন পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিদিন পাঠাগারে গিয়ে পছন্দের কোনো না কোনো বই পড়ি। শুধু আমি একাই নই, আমার বন্ধুরাও নিয়মিত পাঠাগারে এসে বই পড়েন।’
অপর শিক্ষার্থী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে চার-পাঁচ মিনিট হেঁটে ওই পাঠাগারে যাওয়া যায়। তাই সময় পেলে পাঠাগারে গিয়ে বই পড়ি। বই ভালো লাগলে সেখান থেকে বই বাড়িতে নিয়ে আসি।’
বই ঘর পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা মেহেদী হাসান বলেন, ‘দেশের বেশির ভাগ পাঠাগার শহর কেন্দ্রিক। ফলে আমরা যারা গ্রামে বসবাস করি, তাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা বড় ধরনের একটি সমস্যা। এ কারণে গ্রামের তরুণ প্রজন্ম এখন বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গেমসসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মা-বাবার সহযোগিতায় ও টিফিনের টাকা জমিয়ে আমি ২০২০ সালে পাঠাগারটি চালু করি। আমি প্রতিদিন টিফিনের টাকা জমিয়ে কিছুদিন পরপর একটি করে বই কিনতাম। পাশাপাশি অন্যদের কাছ থেকেও বিপুল পরিমাণ বই সংগ্রহ করেছি। আবার অনেকেই এখানে বই দিয়ে গেছেন। ফলে বইয়ের সংখ্যা অল্প সময়ে হাজার ছাড়িয়ে যায়।’এ বিষয়ে শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) প্রধান শিক্ষক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামে মেহেদী নামে যে ছেলে পাঠাগারটি তৈরি করেছে এটা সত্যি বর্তমান সময়ে প্রসংশা পাবার যোগ্য। কেননা, তার মতো অল্প বয়সে ছেলেরা যেখানে টিফিনের টাকা দিয়ে ধূমপান ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত সেখানে মেহেদী তরুণ হয়ে অন্য তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাঠাগার তৈরি করেছে। আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। আগামীতে এমন উদ্যেগে অন্য তরুণদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’