রবিবার, ০৮ জানুয়ারী, ২০২৩
21 Nov 2024 03:03 pm
২০২৩ সালের শুরুতেই ৩ শিশুসহ পাঁচজনকে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনারা। এ ছাড়া ২০২২ সালে ২৩১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরাইল। এর মধ্যে কেবল পশ্চিম তীরেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭৩ জন, যাদের ৩৯ জনই শিশু।
২০০৫ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (অভ্যুত্থান আন্দোলন) পর ২০২২ সালটি ছিল পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ সময়। সে বছরের ১১ ডিসেম্বর ইসরাইলি বাহিনী ১৬ বছরের ফিলিস্তিনি কিশোর জাকারনেহকে মাথায় গুলি করে। এ সময় সে নিজ বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল।
জাকারনেহর মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শতায়েহ, সশস্ত্র সংঘাতে শিশুদের বিরুদ্ধে গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনকারী দেশগুলোর কালো তালিকায় ইসরাইলকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
শুরু থেকে এত হত্যাকাণ্ডের পরও ইসরাইলকে এখন পর্যন্ত এই কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি ২০২১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইসরাইলকে শিশু হত্যা ও তাদের অধিকার খর্ব করার জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা উচিত বলে মত দেয়ার পরও তা করা হয়নি।
গত ২৯ ডিসেম্বর কট্টর দক্ষিণপন্থি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে নতুন করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ নিয়ে সর্বস্তরের ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি বামপন্থিদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর নেতানিয়াহুর সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি নেতানিয়াহুকে ‘বন্ধু’ বলেও অভিহিত করেন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে দুই রাষ্ট্র সমাধানকে বিপন্ন করে এমন নীতির বিরোধিতা করার প্রতিশ্রুতিও দেন বাইডেন। তবে একই সঙ্গে নেতানিয়াহুকে সমর্থন এবং ফিলিস্তিনে দুই রাষ্ট্রের সমাধান কীভাবে হবে সে বিষয়ে বাইডেন কোনো বিস্তারিত রূপরেখা দেননি।
বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু ও সশস্ত্র সংঘর্ষ বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ভার্জিনিয়া গাম্বা সম্প্রতি ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সফর করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সামরিক বাহিনীর প্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। তার সফরকে ইসরাইল যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই নেয়।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর, ভার্জিনিয়ার সফরের সময় তাকে ইসরাইলের পক্ষ থেকে বোঝানো হয়, দেশটি আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলছে এবং সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ইসরাইল ফিলিস্তিনে কৌশলী হয়ে বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইসরাইলি সামরিক কৌশলের নথিতে ‘সামরিক অভিযানের বৈধতা তৈরির’ জন্য জনসাধারণ পর্যায়ে কূটনীতি, তৃণমূল পর্যায়ে অভিযানের বৈধতার পক্ষে মতামত তৈরি করা এবং যুদ্ধের আগে, যুদ্ধ চলাকালে ও পরে আইনি প্রচেষ্টা চালানোর গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
ইসরাইল তার সহিংস কার্যক্রমকে সবসময় লুকিয়ে নির্মিত সত্য হাজির করে বিশ্বকে ধোঁকা দিতে চেয়েছে। তারা নানা কৌশলে আইন অপপ্রয়োগ করছে। সময়ের সঙ্গে আইনি কৌশলে পরিবর্তন এনে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। তেমনই একটি আইনি হলো শিশু অধিকার। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকারের আইনের ক্ষেত্রে ইসরাইল সবচেয়ে বেশি কৌশলী আচরণ করেছে। কাগজে কলমে দেশটিতে শিশু অধিকার বা শিশুদের সুরক্ষায় আইন বা নীতি থাকলেও তা ফিলিস্তিনিদের বেলায় কখনোই মানা হয় না।
ইসরাইল যে আইনের তোয়াক্কা করে না এবং বিশ্বের সামনে মিথ্যা তথ্য হাজির করে তা প্রমাণ পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন গড়ে অন্তত দুজন ফিলিস্তিনি শিশুকে ধরে নিয়ে যায় ইসরাইলি সৈন্যরা। জেলে পুরে চালায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। প্রায় ৭ হাজার শিশুর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘ এবং এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের শুধু ইসরাইলি সেনাদের দিকে পাথর ছোড়ার অভিযোগে আটক করা হয়। শিশুদের ধরতে রাতেও অভিযান চালানো হয়। শিশুদের আটকের সময় তাদের হাত, চোখ শক্ত করে বাধা হয়। সেই অবস্থায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য চালানো হয় নির্যাতন। শিশুদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের ঘটনাও অহরহ।
২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে চালানো জরিপের ভিত্তিতে তৈরি জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন বলছে, এই সময়ের মধ্যে ১৪ বার ফিলিস্তিনি শিশুদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো ভবনে অভিযানের সময়, ফিলিস্তিনিরা যখন পাথর ছুড়তে থাকে তখন ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনি শিশুদের সামনে দাঁড় করায় আটক শিশুদের। উদ্দেশ্য, ঢিল বা গুলি যাই আসুক না কেন আঘাতটা লাগবে শিশুদের গায়ে।
এ ছাড়া প্রতিবছর ইসরাইল সামরিক আদালতে শত শত শিশুকে বিচারের মুখোমুখি করে। এদের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিশুকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। মূলত বেশিরভাগ শিশুকে পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। ইসরাইলি আইনের অধীন ১৮ বছরের কম বয়সীদের বিচার অনুষ্ঠিত হয় বন্ধ দরজার পেছনে, গোপনে।
ইসরাইলি নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য, শিশুদের স্বার্থ রক্ষার্থেই এমন উদ্যোগ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত জনসাধারণ ও মিডিয়া থেকে বিষয়টি আড়াল করতেই এভাবে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইসরাইল। ফলে শিশুদের বিরুদ্ধে আইনের অপপ্রয়োগ ও বিচারের বিষয়গুলো অনেকাংশে আড়াল থেকে যাচ্ছে।
চার বছর আগের একটি ঘটনাই স্মরণ করা যাক। ২০১৮ সালে ১৭ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কিশোর আহেদ তামিমির বিচার করা হয়েছিল ইসরাইলের একটি সামরিক আদালতে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইলি সেনাদের থাপ্পড় মারার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই অপরাধে তামিমিকে ৮ মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।
ঘটনার দিনে ইসরাইলি সেনারা বাড়ি থেকে তামিমির ভাইকে ধরে নিতে এলে তামিমি ইসরাইলি বাহিনীকে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে ইসরাইলি এক সেনা তাকে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করলে তাকে থাপ্পড় মারে তামিমি। তামিমির বিচারের সময়, তার আইনজীবী আদালতেও মিডিয়ার উপস্থিতি চেয়ে আবেদন করে। কিন্তু সামরিক বিচারকেরা ‘শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ’ শীর্ষক আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে সে পথ বন্ধ করে দেয় এবং সাংবাদিকদের আদালত থেকে বের করে দেয়।
২০১৯ সালে ইসরাইলি আইনের একটি সংশোধনী সামরিক বিচারকদের একটি নতুন ক্ষমতা দেয়। তারা ফিলিস্তিনি শিশুদের পুনর্বাসন সম্ভাবনা মূল্যায়ন করতে পারবে এবং শিশুদের রিমান্ডে নেয়ার বিষয়ে বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সামরিক বিচারবিভাগে এমন সংস্কারের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চাপ ছিল। তারা এই বিষয়ে ইসরাইলি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল।
কিন্তু আবেদনকারীরা বুঝতে পারেন, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে শিশু অধিকারের আইন ও নীতিগুলোকে আমলে নিচ্ছে না। তাই তারা পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর তথ্য চেয়ে পাঠান। এই তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসরাইলি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি যুবকদের সাক্ষাৎকার নেন। কিন্তু তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে রেকর্ড করা হয় হয়নি। কিছু তরুণ পরে জানান, তাদের আটকের সময় জোর করে তাদের কাছ থেকে জবানবন্দি নিয়ে এমন মূল্যায়ন তৈরি করা হয়েছিল।
বিষয়গুলো নিয়ে আরও সচেতন হয়ে উঠে ইসরাইল। আন্তর্জাতিক মহল ও মিডিয়াকে দেখাতে ইসরাইল প্রায়ই দেশটির আইন সংশোধন করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি অনুরূপ সংস্কার করেছে। যার সবকটিতে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রেক্ষাপটে গৃহীত হয়েছিল। এসব সংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংস্কার হলো, ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনি শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক বন্দিদের আলাদা করে রাখা। আগে তাদের একসঙ্গে থাকার অনুমতি ছিল।
আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোও কারাগারে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে থাকার অনুমতি দেয়। কিন্তু ইসরাইলি আইনবিভাগ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মধ্যে এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন করেছিল। কেননা ইসরাইলিদের আশঙ্কা ছিল, বড়রা সহজেই শিশুদেরে রাজনৈতিক জ্ঞান দিতে পারে। এটি বন্ধ করতেই এমন আইন পাস করে ইসরাইল। বড়দের কাছ থেকে শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার ফলে তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও ইসরাইলের দাবি, আইনের নতুন সংস্কার অপ্রাপ্তবয়স্কদের অধিকারের সুরক্ষাকে শক্তিশালী করেছে। দেশটির কর্মকর্তাদের দাবি, ইসরাইলে বন্দি ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের পর্যাপ্ত যত্ন নেয়া হচ্ছে, তাদের স্বার্থকে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নানা কৌশলে শিশুদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। কারাগারেও তাদের নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের নূন্যতম আধিকার দেয়া হচ্ছে না।
তবে আশার বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলের বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু তারা প্রকারান্তে ইসরাইলের পক্ষেই কথা বলেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতরকে যখন এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল তখন তারা ইসরাইলের আইনি সংস্কারগুলোকে ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। একইভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরও ইসরাইলের দাবিকে উদ্ধৃত করে বলে, সাম্প্রতিক সংস্কারগুলো ফিলিস্তিনি নাবালকদের চিকিৎসাক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের ভাষ্য ছিল, ইসরাইলের নিজেকে রক্ষার অধিকার রয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে একই বাক্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে থাকেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এর মাধ্যমে মূলত ফিলিস্তিনে ইসরাইলের হামলার ন্যায্যতাই দেয়া হয়। আরও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এসব ঘটনায়, আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদও খুব একটি চোখে পড়ে না।
শিশু অধিকার বিষয়ে ইসরাইলি আইনের প্রয়োগ এবং তৈরি আইনগুলো তাদের নৈতিকতার আবরণ মাত্র। এর পেছনে রয়েছে তাদের কূটকৌশল। তারা বহির্বিশ্ব এবং বৈশ্বিক গণমাধ্যমকে আড়াল করে শিশুদের ওপর নির্যাতনসহ তাদের মানবাধিকার খর্ব করেই চলেছে।