মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫
19 Aug 2025 10:03 pm
![]() |
সম্প্রতি একটি জাতীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন— “পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পের টাকা লুটপাট করেন ডিজি আফজাল”— সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি ও নৈতিকতার পরিপন্থি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নিবন্ধিত সংগঠন বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটিকে অবমাননা করার স্পষ্ট প্রয়াস। সংবাদটিতে একদিকে যেমন প্রমাণহীন দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে, তেমনি একটি বৈধ সামাজিক সংগঠনকে “ভূঁইফোড় সংগঠন” আখ্যা দিয়ে মানহানি করা হয়েছে। এটি নিছক সংবাদ নয়, বরং একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার, যা জাতীয় কৌশলগত প্রকল্প এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।
সাংবাদিকতার নীতি ও নৈতিকতার নগ্ন লঙ্ঘন:
১. প্রমাণহীন অভিযোগ
সংবাদে মহাপরিচালক (ডিজি) আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলেও কোনো সরকারি নথি, নিরীক্ষা প্রতিবেদন, প্রকল্প মূল্যায়ন রিপোর্ট, কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আনুষ্ঠানিক বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়নি।
IFJ Global Charter of Ethics for Journalists (২০১৯) এ বলা হয়েছে:
“Respect for the facts and for the right of the public to truth is the first duty of the journalist.” কিন্তু উক্ত প্রতিবেদনে তথ্য-প্রমাণ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
২. একপাক্ষিক সংবাদ পরিবেশন
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের নীতিমালা অনুযায়ী:
“কোনো সংবাদ প্রকাশের আগে অভিযুক্ত পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করা অপরিহার্য।” কিন্তু এখানে মহাপরিচালক বা বাংলাদেশ রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য নেওয়া হয়নি। Audi alteram partem—অন্য পক্ষকে শোনার নীতি—পুরোপুরি লঙ্ঘিত হয়েছে।
৩. উসকানিমূলক ভাষার ব্যবহার:
“লুটপাট”, “ম্যানেজ”, “ভূঁইফোড় সংগঠন” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে সংবাদকে আবেগপ্রবণ, বিভ্রান্তিকর ও মানহানিকর করা হয়েছে।
UNESCO (2018), Journalism, ‘Fake News’ & Disinformation প্রতিবেদন অনুযায়ী:
“News must not be written in a way that provokes hostility, hatred, or discredits without factual evidence.”
অতএব সংবাদটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা নীতিও ভঙ্গ করেছে।
৪. রাষ্ট্রীয় প্রকল্পকে কলঙ্কিত করা
পদ্মা রেল সেতু একটি রাষ্ট্রীয় কৌশলগত প্রকল্প। এর ব্যয়ের প্রতিটি খাত সরকারি নিরীক্ষা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যাচাই হয়। প্রমাণ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ প্রচার প্রকল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে—যা সরাসরি জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি: রাষ্ট্রীয়ভাবে নিবন্ধিত সংগঠন
সংবাদে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটিকে “ভূঁইফোড় সংগঠন” বলে অবমাননা করা হয়েছে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
১. সংগঠনটি ১৩ আগস্ট ২০১৪ তারিখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে Societies Registration Act, 1860 অনুযায়ী নিবন্ধিত (নং-এস-১১৯৫১)।
২. উদ্দেশ্য: অধিকার বঞ্চিত রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোষ্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, সামাজিক উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা।
৩. একটি নিবন্ধিত সংগঠনকে “ভূঁইফোড়” বলা মানহানিকর, যা বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৫০০-৫০২ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
৪. সোসাইটিস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৬০ এবং সরকারি নিবন্ধন প্রক্রিয়া অনুসারে বৈধভাবে নিবন্ধিত সংগঠনকে ভূয়া বা অবৈধ বলা যায় না।
প্রশ্ন হলো—যদি একটি সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত সংগঠনকে “ভূঁইফোড়” বলা হয়, তবে একই আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত দেশের অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলোকেও কি “ভূঁইফোড়” আখ্যা দেওয়া হবে?
পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প: জাতীয় কৌশলগত বাস্তবতা:
পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অবকাঠামোগত উদ্যোগ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) ও চীনের Exim Bank এর অর্থায়নে প্রকল্পটি পরিচালিত কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (CAG) কর্তৃক নিয়মিত নিরীক্ষিত হয় পরিকল্পনা কমিশনের (২০২২) রিপোর্ট অনুযায়ী প্রকল্পটি বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে ১.২% অবদান রাখবে। কোনো দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার একমাত্র পথ হলো সরকারি তদন্ত সংস্থা ও আদালতের রায়— সংবাদপত্রের একতরফা প্রতিবেদন নয়।
আইনি ও নৈতিক কাঠামো:
১. সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৯: সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রয়েছে, তবে তা মানহানি, মিথ্যা প্রচার বা অপপ্রচারের স্বাধীনতা নয়।
২. বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪: সংবাদ অবশ্যই সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও প্রমাণভিত্তিক হতে হবে।
৩. দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা ৫০০-৫০২: মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানহানি করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ।
আন্তর্জাতিক রেফারেন্স:
UDHR Article 19: তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে, তবে সেটি হতে হবে দায়িত্বশীল ও সত্যনিষ্ঠ।
Lingens v. Austria (ECHR, 1986): সংবাদপত্র সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু “false factual allegations” গ্রহণযোগ্য নয়।
UNESCO Windhoek Declaration (1991): স্বাধীন ও বহুমুখী গণমাধ্যম গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
কঠোর প্রতিবাদ ও নিন্দা:
এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ কেবল একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি জাতীয় কৌশলগত প্রকল্প এবং একটি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিবন্ধিত সংগঠনের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। এটি সাংবাদিকতার স্বাধীনতার অপব্যবহার, যা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধ্বংস করে এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ভিত্তিহীন, তথ্যবিহীন, সাংবাদিকতার নীতি বহির্ভূত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি একটি সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত বৈধ সংগঠন— যাকে “ভূঁইফোড়” বলা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিকে অস্বীকার করার সামিল।
চূড়ান্ত বার্তা
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীলতা, প্রমাণভিত্তিকতা ও নিরপেক্ষতা। অথচ উক্ত প্রতিবেদন প্রমাণ করে দিয়েছে—কিছু গণমাধ্যম ব্যক্তিগত স্বার্থ, বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। জাতীয় স্বার্থবিরোধী এ ধরনের সংবাদকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা জানাচ্ছি।
লেখক:সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সংবাদ বিশ্লেষক