শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫
19 Aug 2025 04:57 am
![]() |
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ-গাইবান্ধা সদর হাসপাতাল জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের প্রধান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হলেও এখানে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার।২৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, আধুনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষ নার্স, কিংবা জরুরি ওষুধ। ফলে একটু জটিলতা দেখা দিলেই ‘রেফার্ড’—এ যেন রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল ছয়মাসে ৬টি বিভাগে প্রায় ১৬০০ রোগীকে রেফার্ড করেছে হাসপাতালটি। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২০০ রোগীর।হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয় গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল। এরপর ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় এ চিকিৎসা কেন্দ্রটি। কিন্তু ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও আজও এটি চলছে ১০০ শয্যার অবকাঠামো ও জনবল দিয়েই।
চিকিৎসক সংকট
সরকারি তালিকায় থাকা ৪৩ জন চিকিৎসকের স্থলে বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ১৮ জন। দীর্ঘদিন ধরে ২৫ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। বিশেষত মেডিসিন বিভাগে একজন, সিনিয়র কনসালটেন্ট ইএনটি (নাক, কান, গলা) বিভাগে একজন, সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) বিভাগে দুইজন, সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু) বিভাগে দুইজন, সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন) বিভাগে দুইজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বিভাগগুলোতে দীর্ঘদিন থেকেই নেই চিকিৎসক। এছাড়া ১০০ শয্যা হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন খাতে কর্মচারীর পদ সংখ্যা ১৯১টি। এরমধ্যে ৫২টি পদই শূন্য রয়েছে।জরুরি বিভাগের বেহাল দশা রোগীর প্রথম ভরসা জরুরি বিভাগ। কিন্তু সেখানেও নেই জরুরি ওষুধ, পর্যাপ্ত অক্সিজেন কিংবা ট্রমা কিট। অ্যাম্বুলেন্সও একটিমাত্র, যা প্রায়শই অচল হয়ে থাকে। কোনো মুমূর্ষু বা জটিল রোগী এলেই হাসপাতালের স্টাফদের প্রথম কথা, রংপুরে রেফার্ড করতে হবে।
প্রতিদিন কি পরিমাণ কিংবা মাসে কতজন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করা হয়েছে তার লিখিত কোনো ডকুমেন্টই দেখাতে পারেনি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এমনকি কোন ধরনের রোগীদের পাঠানো হয়ে থাকে তাও বলতে পারেননি তারা। তবে, দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনচার্জ মোজাম্মেল হক জানান, গড়ে প্রতিমাসে ৩০ জন রোগীকে রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। তার ডকুমেন্ট তো রাখা হয় না। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অধিক।প্রতিমাসে উদ্বেগজনক রেফার্ড হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত হাসপাতালের মহিলা, পুরুষ, গাইনি, শিশু, স্ক্যানু ও ডাইরিয়া বিভাগ থেকে ১৫৬৮ জনকে রেফার্ড করা হয়েছে। যা গড়ে প্রতিমাসে ২৬১ জনের বেশি এবং প্রতিদিন প্রায় ৯ জনের মতো।
যার মধ্যে অনেক রোগী এমনও থাকেন, যাদের গাইবান্ধা সদরেই সেবা দেওয়ার কথা ছিল। ফলে রোগীর পরিবারের সময়, অর্থ, ও মানসিক চাপ—সবকিছু বেড়ে যায় বহুগুণে। এছাড়া একই সময়ে মারা গেছে ১৮৫ জন চিকিৎসাধীন রোগী।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনোযোগের অভাব
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনোযোগের অভাব দীর্ঘদিনের। যদিও মাঝে মাঝে পর্যবেক্ষণ টিম আসে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা কমিটি কার্যত নিষ্ক্রিয়। কেননা, গণপূর্ত বিভাগ ২০১৮ সালে ৩৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্যা ২৫০ শয্যার নয়তলা হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করেন এবং ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে গণপূর্ত বিভাগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ভবনটি বুঝিয়ে দেন। ভবন বুঝে পাওয়ার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও হাসপাতালের নবনির্মিত ভবন চালু করা হয়নি। ফলে পুরোনা ৫০ শয্যার অবকাঠামোতে ৩০ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা চলছেই।রোগীদের জীবন নিয়ে খেলা এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ রোগীদের জীবন নিয়ে যেন খেলছে স্বাস্থ্য প্রশাসন। হৃদরোগ, গর্ভবতী মা, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি—সবার জন্যই রেফার্ড মানে এক অনিশ্চিত ভ্রমণ। অনেকেই পথেই মারা যান, কেউ বা পৌঁছে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ জটিল অবস্থায় ভর্তি সেখানে ভর্তি হন।
রংপুরে চাপ, গাইবান্ধায় শূন্যতা
গাইবান্ধা থেকে প্রতিদিন রংপুরে রোগী রেফার্ড করার ফলে সেখানকার হাসপাতালেও সৃষ্টি হচ্ছে চাপ। অন্যদিকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতাল জটিল রোগীহীন হয়ে পড়ে, অথচ কাঠামো এবং অবকাঠামো রয়েছে বেশ ভালো মানের।জনগণের দাবি পর্যাপ্ত চিকিৎসা চাই সাধারণ মানুষের দাবি একটাই—রেফার্ড নয়, চিকিৎসা চাই।তারা চায়, গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে যেন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালু হয়, সব বিভাগে নিয়মিত চিকিৎসক থাকুক, জরুরি বিভাগ হোক কার্যকর, এবং রেফার্ড করার প্রবণতা বন্ধ হোক। স্বাস্থ্যসেবাকে স্থানীয়করণ না করে যতদিন রেফার্ড পলিসি চলবে, ততদিন গাইবান্ধা সদর হাসপাতাল থাকবে শুধু একটি নামমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে—রেফার্ড টু রংপুর এর ছাপ নিয়ে।
এদিকে, এতো এতো রেফার্ড প্রশ্নে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত চিকিৎসক সংকটের কারণে রোগীর প্রয়োনীয় চিকিৎসা না দিতে পারায় রেফার্ড করা হয়। ইচ্ছাকৃত কোনোভাবেই রোগী হয়রানি করতে রেফার্ড করা হয় না। যেসব রোগের ডাক্তার নেই, ওই সকল রোগীদের চিকিৎসা সেবায় ব্যর্থ হয়ে রেফার্ড করা হয়।
হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার বীণা পানি গোলদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট। এমনকি মেডিসিন ও হার্ডের চিকিৎসক নেই। আমরা রীতিমতো হিমশিম খাই চিকিৎসা সেবায়। জনবল নেই বললেই চলে। অথচ প্রতিদিন ৩০০ এর বেশি রোগী ভর্তি থাকে হাসপাতালে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক স্টাফ বলেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে আমরা অনেক সময় বাধ্য হয়ে রোগীকে রেফার্ড করি। লোকবল কম, চাপ বেশি—চিকিৎসা দিতে পারি না।
জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ৫ জুলাই রংপুরে রেফার্ড করা হয় গিদারী গ্রামের মেসের আলীকে। এছাড়া শুধু জ্বর নিয়ে ভর্তি হওয়া শহরের সরকার পাড়ার ইশানকেও রেফার্ড করা হয় রংপুরে। রোগীর স্বজনরা জানান, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ডাক্তার রংপুর নিতে বলেছে তাই রমেকে যাচ্ছি।রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের আংগুরানি বলেন, আমার ৪ বছরের নাতির পেট ফাপা নিয়ে ভর্তি করি। কিন্তু ডাক্তার ইন্জেকশন দিয়ে বলে রংপুর যাও রেফার্ড করা হয়েছে। আমরা গরিব যেতে পারিনি। পরে গ্রাম্য ডাক্তারের চিকিৎসা করে নাতি আজও বেঁচে আছে।
বুকে ব্যথা নিয়ে রংপুরে রেফার্ড হওয়া উত্তর হরিণ সিংহা গ্রামের তৌহিদ বলেন, বুকে ব্যথা অনুভব হলে সদর হাসপাতালে ভর্তি হই। তিনদিন পর আমাকে রংপুরে রেফার্ড করা হয়। রংপুর গিয়ে পরদিনই সুস্থ হই। রংপুরে তেমন চিকিৎসা লাগেনি। আমার মনে হয় এখানেই সুস্থ হতাম।
গাইবান্ধার নারী মুক্তি কেন্দের আহ্বায়ক নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পি বলেন, গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা নেই। আছে রোগী হয়রানি, দালালের দৌরাত্ম। সামান্য কিছু হলেই তারা দায় এড়াতে রেফার্ড করে বাইরে।
এখানে ডাক্তার নেই, নার্স নেই। সেটা নিয়ে সরকারের কোনো দৃষ্টি নেই। তিন বছর আগে হাসপাতালের বহুতল ভবন কমপ্লিট হলেও আজ চালু করা হয়নি। এটা সরকার পক্ষের চরম অবহেলা।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন বলেন, এই হাসপাতালে অব্যবস্থাপনায় ভরা। দুর্গন্ধে থাকা যাচ্ছে না। সুস্থ মানুষও এখানে এলে রোগী হয়ে যায়। এসবের কবে প্রতিকার পাবো। অপর আরেক রোগীর স্বজন বলেন, স্যালাইন ছাড়া কিছুই দেয়নি বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে সব ওষুধ।
তবে, হাসপাতালের আরএমও আসিফ উর রহমান এসব সংকটের কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, এটা ২৫০ শয্যার হাসপাতাল ঘোষণা করা হলেও এখানে জনবল দেওয়া আছে ১০০ শয্যার হিসেবে। সেখানেও চিকিৎসক সরঞ্জাম যথেষ্ট সংকট।
রেফার্ড প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের চিকিৎসকের যথেষ্ট ঘারতি আছে এবং রোগ অনুসারে চিকিৎসক একেবারে নাই। ফলেআমরা রোগ চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে না পেরে রেফার্ড করতে বাধ্য হই। তবে আমাদের যা আছে তাই নিয়ে যথেষ্ট চেষ্টা করিঅ
এছাড়া বহুতল ভবনটি চালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমরা ভবনটি বুঝে নিয়েছি। কিন্তু কেবল ভবন। এটি চালু করতে জনবল এবং সরঞ্জমাদির প্রয়োজন সেটি পেলেই চালু করা হবে। তবে ঠিক কবে নাগাদ চালু হবে সেই বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি তিনি।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. রফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঠুনকো কোনো বিষয় নিয়ে রোগীদের রেফার্ড করা হয় না। এর পেছনে যথেষ্ট কারণ থাকে। ডাক্তারদের সংকট তার মধ্যে অন্যতম কারণ।হাসপাতালে রোগী আসলে আমরা সাধারণত চেষ্টা করি তাকে যথেষ্ট সেবা দেওয়ার জন্য। কিন্তু যন্ত্রপাতির সংকট ডাক্তারদের সংকট এবং নানা পারিপার্শ্বিকতার কারণে রোগীদের রংপুরে রেফার্ড করা হয়। তারপরও অনেক রোগী আমাদের এখানে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হচ্ছে।তিনি আরও বলেন, অনেক সময় রোগীর স্বজনরাও এখানে চিকিৎসা নিতে অস্বস্তি বোধ করেন। যার কারণেও রোগীদের রংপুরে রেফার্ড করা হয়।এছাড়া আমাদের এখানে আইসিইউ সাপোর্ট নেই, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব। ২৫০ শয্যার হাসপাতাল ঘোষণা করা হলেও এখানে জনবল দেওয়া আছে ১০০ শয্যার। সেখানেও ডাক্তারদের সংকট। সব মিলিয়ে নানাবিধ সমস্যার কারণে রোগীদের রেফার্ড করা হয়।
তিনি বলেন, আমরা চিকিৎসকদের শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আসছি এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহের জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। মোটকথা হাসপাতালের ঘাটতিগুলো পূরণ হলে রেফার্ডের পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।