বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট, ২০২৫
19 Aug 2025 04:50 am
![]() |
এক বছর পর—স্বৈরাচারমুক্ত একটি প্রতিশ্রুতির পথে:২০২৪ সালের ২৪ জুলাই, এক অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দমন-পীড়নে ভরা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন,যাঁরা রক্ত ঝরিয়েছিলেন কিংবা প্রতীকী নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন—তাঁদের সবাইকে আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এই দিনটি শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপান্তর নয়, এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে এক নতুন কাঠামোয় দাঁড় করানোর দিন হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
এই এক বছরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কেন্দ্র করে জাতি যেমন প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছে, তেমনি নানা ধরনের প্রতিকূলতা, চক্রান্ত ও অভ্যন্তরীণ-আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখিও হয়েছে। হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক ও আশাব্যঞ্জক।
তবে, ইতিহাস জানে—শুধু সরকারের পতনই পরিবর্তন নয়; প্রকৃত পরিবর্তন তখনই আসে, যখন কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো মেরামত হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নৈতিকতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত হয়, এবং ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন সরকারকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো প্রয়োজন, যা শুধু এই মুহূর্তকে রক্ষা করবে না বরং আগামী দিনের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন করবে।
সরকার এর কাছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিত্তি আরো দৃঢ় করতে কিছু নীতিগত অনুরোধ তুলে ধরছি--
১. রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও প্রতিহিংসা প্রতিরোধ আইন: ইতিহাসের চাকা যেন উল্টে না যায়-
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দুঃখজনক বাস্তবতা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান—ক্ষমতা পরিবর্তনের পরপরই আগের সরকারের সমর্থকদের উপর শুরু হয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বিচার বহির্ভূত হেনস্থা, এবং প্রশাসনিক নিপীড়ন। এই অমানবিক চক্র থেকে বেরিয়ে আসা না গেলে, গণতন্ত্র শুধু প্রতীকী থাকবেই, বাস্তবে কখনোই জনগণের মালিকানায় রূপ পাবে না।
২০২৪ সালের ২৪ জুলাই গণঅভ্যুত্থান কোনো একক দলের উদ্যোগ ছিল না; এটি ছিল সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ। এই বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কা তৈরি হয়—এই মানুষগুলো ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হবেন কিনা।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একটি নজির স্থাপন করতে পারে—একটি আইন প্রণয়ন করে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা থাকবে যে, ২৪ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কেউই কোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার হবেন না।
এ ধরনের আইন শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক সৌজন্যবোধেরও বহিঃপ্রকাশ। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার “ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন”, আর্জেন্টিনার “ডেমোক্রেসি ট্রানজিশন ফ্রেমওয়ার্ক”—বাংলাদেশেও এমন একটি “ন্যাশনাল গ্যারান্টি ফর ডেমোক্রেসি অ্যাক্ট” প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
২. রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নের স্বচ্ছতা: কারা দিচ্ছে টাকা, কেন দিচ্ছে—জানতে চায় জনগণ-
রাজনীতিতে বড় পুঁজির প্রভাব যত বেশি বাড়ে, ততই জনস্বার্থ হুমকির মুখে পড়ে। বাংলাদেশে এখনো কোনো রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন কাঠামো জনসমক্ষে স্বচ্ছ নয়। এর ফলে জনগণ জানে না কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কী স্বার্থে কোন দলকে অর্থায়ন করছে।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে “Political Finance Transparency Act” চালু করা হোক, যার অধীনে—
• রাজনৈতিক দলগুলো ১ লাখ টাকার বেশি অনুদানের উৎস ও উদ্দেশ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবে
• বিদেশি দান গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে
• নির্বাচনের ছয় মাস আগে থেকে দলীয় ব্যয়ের পূর্ণ হিসাব জমা দিতে হবে
এতে শুধু রাজনৈতিক স্বচ্ছতাই আসবে না, দুর্নীতির গোপন চক্রও ভেঙে পড়বে।
৩. অর্থ পাচার রোধে বৈশ্বিক চুক্তি: বিনিয়োগের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন আবশ্যিক হোক-
সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ—এই দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের নামে যে বিপুল সম্পদ রয়েছে তার অধিকাংশই আসে পাচারকৃত অর্থ থেকে।
বাংলাদেশের উচিত এ সকল দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক আর্থিক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি করা, যাতে:
• কোনো বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়
• বিদেশি সরকার বিনিয়োগকারীর পরিচয় ও সম্পদের তথ্য বাংলাদেশকে জানাতে বাধ্য হয়
• সন্দেহভাজন লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অস্থায়ী জব্দাদেশ দিতে পারে
এটি অর্থপাচার রোধে বাস্তবিক পদক্ষেপ হবে।
৪. বৈধ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ: প্রণোদনার মাধ্যমে স্বচ্ছ আন্তর্জাতিক ব্যবসা-
অনেক স্বচ্ছ ব্যবসায়ী বিদেশে বৈধভাবে ব্যবসা করতে চান। তাঁদের জন্য দরকার—
• বিদেশে বিনিয়োগে উৎস ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা
• লাভ দেশে ফিরিয়ে আনার ওপর কর ছাড়
• নিবন্ধিত পথে বিনিয়োগে প্রণোদনা
এভাবে বৈধ ব্যবসা বাড়বে, পাচার কমবে, কর্মসংস্থানও তৈরি হবে।
৫. বাংলাদেশ ট্রেড প্রমোশন এজেন্সি: বাণিজ্যিক কূটনীতির নতুন অধ্যায়-
বাংলাদেশকে এখন আর শুধু শ্রমনির্ভর অর্থনীতি নয়, বাণিজ্যনির্ভর কূটনীতি-তে যেতে হবে। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশে বাংলাদেশ ট্রেড প্রমোশন অফিস চালু করতে হবে—
• যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, সৌদি আরব ও চীন
• এই অফিসগুলো রপ্তানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করবে
• চেম্বার ও উদ্যোক্তাদের সরাসরি সংযুক্ত করা হবে
এতে করে বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসা ও শ্রমবাজারের নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
৬. নিরাপত্তা বাহিনীর depoliticization: পেশাদারিত্বে ফিরিয়ে আনার ঐতিহাসিক সুযোগ-
• পদোন্নতি যেন রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে না হয়
• সেনা ও পুলিশ বাহিনীতে অভ্যন্তরীণ বোর্ড কর্তৃক মূল্যায়ন প্রথা চালু
• আইজিপি/সেনাপ্রধান নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ফর্মেশন কমান্ডার ও মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ বাধ্যতামূলক
• ৬ মাস অন্তর আমলাদের কাজের মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ
এটি দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে নিরপেক্ষ ও পেশাদার রাখবে।
৭. গোয়েন্দা সংস্থার জনসম্পৃক্ততা ও স্বচ্ছতা: একটি ওভারসাইট বোর্ড গঠনের প্রস্তাব-
• সংসদীয় প্রতিনিধিত্বসহ একটি “ইনটেলিজেন্স ওভারসাইট বোর্ড” গঠন করা হোক
• প্রতিটি সংস্থার জনসম্পৃক্ত কার্যক্রম পর্যালোচনা
• মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে স্বাধীন তদন্ত
• গোপনীয়তা বজায় রেখে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ
এটি জনগণের আস্থা বাড়াবে এবং গোয়েন্দা বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
৮. নিরাপত্তা বাহিনীর ও বিশেষায়িত কারিগরি প্রতিষ্ঠান এর পোষ্য সুরক্ষা: একটি মানবিক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি-
• পুলিশ, আনসার, বিজিবির সাধারণ সদস্যদের রেশন ও ঝুঁকি ভাতা বৃদ্ধির সাথে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ঝুঁকি ভাতা ও রেশনিং ব্যাবস্থা গ্রহণ
• পোষ্যদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিয়োগে অগ্রাধিকার
• সব বাহিনীতে এবং বিশেষায়িত কারিগরি প্রতিষ্ঠানে পোষ্য কোটা আইন করে নিশ্চিত করা
• পরবর্তী সরকারের জন্য সুপারিশ সম্বলিত পরিকল্পনা প্রকাশ করা
এতে তারা রাষ্ট্রের প্রকৃত সেবক হিসেবে মর্যাদা পাবেন।
৯. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও হুইসেল ব্লোয়ার নিরাপত্তা: গণতন্ত্রের প্রাথমিক রক্ষাকবচ
• প্রতিটি মিডিয়ার সম্পাদনা নীতিমালা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা
• হুইসেল ব্লোয়ার সুরক্ষা আইন পাস
• সাংবাদিকদের হয়রানির বিরুদ্ধে “মিডিয়া সুরক্ষা কমিশন” গঠন
• মালিক পক্ষের প্রভাব প্রতিরোধে আইনগত সীমা নির্ধারণ
এতে সাংবাদিকতা হবে সাহসী ও দায়িত্বশীল।
১০. ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মুক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাস্তব চর্চা
• রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তারকৃত আলেম ও ধর্মীয় নেতাদের মামলা পুনঃমূল্যায়ন
• সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সহায়তা নিশ্চিত
• ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতার বার্তা রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরদার করা
এটি দেশের সামাজিক ঐক্য ও শালীনতা নিশ্চিত করবে।
আগামী বাংলাদেশের রূপরেখা আজই আঁকা হোক:
যে ১০টি অনুরোধ তুলে ধরা হয়েছে, তার প্রতিটি মূলত একটি ভবিষ্যৎগামী রূপরেখা—যা বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি জাতীয় রূপান্তর নীতি ঘোষণা করতে পারে, যা কেবল অস্থায়ী বাস্তবতা নয়, বরং স্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত গড়ে তুলবে।
বাংলাদেশের নতুন ভোর শুরু হোক সত্য, ন্যায় ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি