বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫
25 Jul 2025 08:33 am
![]() |
বর্তমান রাজনীতিবিদরা দেশ এবং জাতির কল্যাণের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে। তারা রাজনীতিকে বানিয়েছে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের পথ। ব্রিটিশরা ২০০ বছরে যা করতে পারেনি, এদেশের স্বার্থান্বেষী, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক রাজনীতিবিদরা ৫৪ বছরেই তা করে ফেলেছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতি হতে হবে উদার-নৈতিক, সংকীর্ণমনা নয়। তবে এমন রাজনীতিবিদ সমাজে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এখনকার রাজনীতিকে সবাই মনে করে ক্ষমতা এবং টাকার মহোৎসব। রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারলেই ভুরি ভুরি টাকার মালিক হবে, সবসময় ক্ষমতা নিয়ে চলাফেরা করবে। এমন মানসিকতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের অভাব বর্তমান সমাজে নেই বললেই চলে। বরং অভাব একজন আদর্শিক রাজনীতিবিদের।
জুলাই-আগস্টের ভয়াবহ গণহত্যার পরও যদি সাধারণ মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন হতে থাকে এবং রাজনীতিবিদরা যদি মানুষের কল্যাণের বদলে ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে পড়েন, সরকারি অফিস-আদালতের কর্মচারীরা যদি সততার পথ ছেড়ে দুর্নীতির পথ বেছে নেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চেয়ে স্বার্থসিদ্ধিকে প্রাধান্য দেন, রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা যদি দেশপ্রেমের বদলে স্বার্থপরতায় মগ্ন হন, কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুররা যদি ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়-তাহলে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের ভিত্তি নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠবে।
যদি বড় দলগুলো তাদের কর্মীদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান বন্ধ করে দেয়, তাহলে দেখা যাবে অল্প সময়ের মধ্যেই এসব দলের প্রভাব ও কার্যক্রম প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ, অনেক নেতাকর্মীই এসব দলের সাথে যুক্ত থাকে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার আশায়। এটি স্পষ্ট যে, এই অবৈধ সুযোগ-সুবিধাগুলো দেশের কল্যাণ বা সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য নয়, বরং এটি দেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
বর্তমান সময়ে যারা প্রচলিত রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তাদের মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেমিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারা সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা মুখে বললেও, বাস্তবে তাদের কার্যকলাপ শুধুই ব্যক্তিগত বা দলের স্বার্থে আবদ্ধ। এ ধরনের রাজনীতির ফলে দেশের সাধারণ মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন উপেক্ষিত থাকে, এবং দেশ ক্রমেই দুর্নীতি ও অনৈতিকতার দিকে ধাবিত হয়। সুতরাং, রাজনীতি হতে হবে এমন একটি মাধ্যম, যা শুধুমাত্র দেশের এবং সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত।
বর্তমান সময়ে যে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলকে মানুষ বিশ্বাস করে বা মেনে চলে, তা পরিবর্তন না হলে দেশের উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের মুক্তি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বর্তমান সময়ের এই রাজনৈতিক সিস্টেমটি মূলত সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এবং বোকা বানিয়ে দেশের সম্পদ লুট করার একটি পদ্ধতিগত ব্যবস্থা। এর বাইরে এটি আর কিছুই নয়।
সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দরকার এমন নেতৃত্ব, যাঁরা দলে নন, মূল্যবোধে বিশ্বাস রাখেন; যাঁরা জনতার পাশে দাঁড়ান, ক্যামেরার সামনে নন; যারা নীতির পক্ষে যান, সংখ্যার পক্ষে নন। আজ যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র সংকটে, তখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেবল সংবিধানের পাতায় নয়, মানুষের মনের ভেতরে জাগ্রত হওয়া জরুরি। তার জন্য চাই রাজনীতিকে পুনঃ আবিষ্কার। দল থেকে শুরু করে নাগরিক পর্যন্ত—সর্বস্তরে একটি নৈতিক বিবর্তন।
রাজনীতিবিদেরা অনেক সময় বলেন, ‘আমরা জনগণের জন্য কাজ করছি।’ কিন্তু কারা সেই জনগণ? চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত? নগরের রাজনৈতিক কর্মী? নাকি সেই কিষানি নারী, যিনি নওগাঁর কোনো হাটে এক কেজি চাল বিক্রি করে সন্তানের জন্য ওষুধ কিনেছেন? ঢাকায় তাঁর গল্প শোনা যায় না, তাঁর চোখের ভাষা রাজনীতির টেবিলে অনুবাদ হয় না।
বাংলাদেশে রাজনীতির একটি ভয়ংকর প্রবণতা হলো ‘গণতন্ত্র’ শব্দের অসাধারণ অপচয়। এই শব্দকে যাঁর যাঁর মতো ব্যবহার করে সবাই নিজের বক্তব্য বৈধ করেন। অথচ ‘গণতন্ত্র’ মানে কেবল নির্বাচন নয়, এটি মানসিক পরিসরের প্রসার, যেখানে ভিন্নমত থাকলেও নিরাপত্তা থাকে, দ্বিমত থাকলেও মর্যাদা থাকে।
কিন্তু এখানে কী হয়? ভিন্নমত মানেই ‘রাষ্ট্রবিরোধী’। নিরপেক্ষতা মানেই ‘অজুহাত’। প্রশ্ন মানেই ‘ষড়যন্ত্র’। এমন একটি রাজনীতিতে নাগরিকেরা নিজেদের অনাহূত অনুভব করেন। একসময় মনে করা হতো, ক্ষমতার পরিবর্তন মানেই রাজনীতির পরিবর্তন। এখন বাস্তবতা বলছে—ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও আচরণের, নৈতিকতার, ভাষার ও দৃষ্টিভঙ্গির কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে না। বদলায় শুধু ব্যক্তি, একই থাকে রাজনীতি। এখানেই প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই পরিবর্তন চাই? নাকি ক্ষমতায় পৌঁছানোর একটি ‘সহজ পথ’ খুঁজি?
রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে ওঠার একমাত্র পথ নৈতিক নেতৃত্বের উত্থান। এমন নেতৃত্ব, যাঁর কাছে জনতার চোখের জল সংখ্যা নয়, যাঁর কাছে জনগণ শুধুই ‘ভোটব্যাংক’ নয়, বরং সম্মানিত স্বতন্ত্র মানুষ। যাঁরা নিজের দলের ভেতরেই সত্য উচ্চারণ করতে ভয় পান না, যাঁরা নিজের অবস্থান দিয়ে নয়, জনগণের অবস্থান দিয়ে সমাজকে বোঝেন।
আমরা এদেশকে একটা সুস্থ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। রক্তমূল্যে পাওয়া এদেশ। তাই দেশপ্রেমিক প্রতিটা রাজনীতিবিদ, সুনাগরিক সুশীল সমাজকে এখন এটা ভাবতে হবে যে আমরা কি চাই? আমরা কি একটা সুস্থ নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই না? কারো ক্ষমতায় থাকা বা কারো ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে ২০ কোটি মানুষের এই দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হতে পারেনা। নাগরিক সমাজের সুশীল ব্যক্তিদের দলবাজি ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে একটা সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনণের পক্ষে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কথা বলতে হবে। জনগণ চায় শুধুই রাজনীতির জন্য নয়, দেশের জন্যই হোক আমাদের রাজনীতি।
আবুল কালাম আজাদ,নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।