শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫
21 Jul 2025 03:18 am
![]() |
প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বাস্তবতার রূঢ় চিত্র:
১৭ জুলাই রাজধানীর রেলভবনে বৃস্পতিবার সকাল ১০:৩০ মিনিটে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ ফাহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ আফজাল হোসেনসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনউদ্দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। তিনি স্বীকার করেন, যেখানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ৩০-৩৫ শতাংশ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন হয় রেলের মাধ্যমে, সেখানে বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনের হার মাত্র ২ শতাংশ।
এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী এবং উচ্চাভিলাষী। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে এই লক্ষ্যের দিকে আমরা কতটা এগোচ্ছি? বর্তমান রেলওয়ের কাঠামোগত দুর্বলতা, প্রশাসনিক সংকট, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের অধিকার হরণ এবং জনপ্রশাসন ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে একটি সংকটাপন্ন, দিশেহারা রাষ্ট্রীয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক সংকট:
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক একটি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রধান, কিন্তু আজ তার হাতে প্রকৃত কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। রেলওয়ে পূর্ববর্তী সময়গুলোতে নিজের বাজেট, পরিকল্পনা, জনবল নিয়োগ, উন্নয়ন প্রকল্প সবকিছুতেই ন্যূনতম স্বাধীনতা উপভোগ করত। কিন্তু আজ রেলপথ মন্ত্রণালয় নামক রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ছায়াতলে প্রতিটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে “চূড়ান্ত কর্তৃত্ব” রাখছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রনালয় ।
যেখানে মন্ত্রণালয় নীতিগত নির্দেশনা দেওয়ার কথা, সেখানে তারা হয়ে উঠেছে রেলওয়ের নিয়োগকারী, বদলি কর্তৃপক্ষ, এমনকি তদন্তকারী সংস্থাও! ফলে রেলওয়ের কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
নিয়োগ,বদলি,পদোন্নতিতে দুর্নীতির মহোৎসব:
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। চাকরি দেওয়ার নামে প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ ও আমলারা ঘুষ, সুপারিশ ও দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দিচ্ছে। চাকরি পাওয়ার পূর্বেই অর্ধেক প্রশিক্ষত রেলওয়ে পোষ্যদের অধিকার বঞ্চিত এবং গত ২৭ ডিসেম্বর /২১ থেকে অবৈধভাবে জনবল নিয়োগ এ ধরনের অনিয়ম শুধু দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি সৃষ্টি করে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে রেলওয়ের নিরাপত্তা ও যাত্রীসেবা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
বিশেষ করে রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল যারা রেলওয়ের প্রাণ হিসেবে কাজ করেন—তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। আবার যারা প্রকৃত প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে, তারা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও স্থায়ী নিয়োগ পাচ্ছে না। অন্যদিকে অনভিজ্ঞ ও অযোগ্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
রেলওয়ের কর্মচারী ও পোষ্যদের অবহেলিত অধিকার:
বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি “সম্পর্কনির্ভর” প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের সন্তানরাও রেলওয়ের পোষ্য হিসেবে স্বীকৃত এবং অতীতে নিয়োগে পোষ্য কোটার ভিত্তিতে যথাযথ অগ্রাধিকার পেত। আজ এই প্রক্রিয়াটি কার্যত বন্ধ। অথচ ৭৫ বছরের ঐতিহ্য ও সাংবিধানিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে পোষ্যদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্মূল্যায়ন ছাড়াই।
এতে শুধু কর্মচারী পরিবারগুলোর মানবিক, অর্থনৈতিক সংকটই বাড়ছে না, বরং এই কোটা বাতিলের মাধ্যমে রেলওয়ে তার “কাস্টমাইজড হিউম্যান রিসোর্স” তৈরির ক্ষমতা হারাচ্ছে।
আরএনবি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংকট:
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) ও রেলওয়ে পুলিশ—দুই পক্ষই বর্তমানে চরম জনবল সংকটে ভুগছে। একদিকে প্রতিদিন ট্রেনে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে নিরাপত্তাকর্মীরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম, প্রণোদনা ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীরও বদলি বা নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান এবং রেলপথ মন্ত্রনালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যত্রুম এর নামে বছর হাজার হাজার শ্রমঘন্ট অপচয় করছে। অবস্থা দেখে মনে হয় এটা তামাক নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রনালয়।
রেলপথে দূর্নীতির চিত্র:
রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ হলেও বাস্তবে এর সিংহভাগ ব্যয় হয় ফাইল চক্র ও কমিশন সিন্ডিকেটের পকেটে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় এক যুগ পরে, তার আগেই রেললাইন ভেঙে পড়ে বা স্টেশন অকার্যকর হয়ে পড়ে।
অনেক সময় আধুনিকীকরণের নামে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যেগুলো ব্যবহার করার মতো দক্ষ জনবল নেই, আর মেরামতের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয় না। এর ফলে রেলওয়ের লজিস্টিক, কারিগরি ও অপারেশনাল ব্যাকআপ পুরোপুরি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।
কার্যকর পরিবর্তনের জন্য করণীয়:
১. বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন সংশোধন ও আধুনিকীকরণ
বর্তমান আইন অনুযায়ী রেলওয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা পুরোপুরি মহাপরিচালকের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
২. পোষ্য কোটা পুনর্বহাল ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ
রেলওয়ে পোষ্যদের জন্য আলাদা নীতিমালা করে তাদের মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। এটি শুধু মানবিক দায় নয়, রেলওয়ের ভবিষ্যৎ দক্ষ জনবল গঠনের অংশ।
৩. দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বচ্ছ কমিটি ও প্রতিবেদন প্রকাশ
প্রত্যেক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রয়োজনে রেলওয়ে সৎ কর্মকর্তাদের দিয়ে অডিট ও তদন্ত করিয়ে প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
৪. সামগ্রিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটি গঠন
ড. শেখ মইনউদ্দিন যে সমন্বিত যোগাযোগ মহাপরিকল্পনার কথা বলেছেন, সেটি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট টাইমলাইন ও ফলোআপ কমিটি গঠন করতে হবে, যেখানে সড়ক, নৌ ও রেল কর্তৃপক্ষ একসাথে কাজ করবে।
৫. রেলওয়ের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন
মহাপরিচালককে সচিব পদমর্যাদা দিয়ে পূর্ণ প্রশাসনিক স্বাধীনতা দিতে হবে। রেলওয়ে হতে হবে একটি প্রফেশনাল, কারিগরি, আধুনিক প্রতিষ্ঠান—না যে একটি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণাধীন অফিস।
রেল বাঁচলে রাষ্ট্র বাঁচবে:
রেলপথ একটি দেশের জনগণের অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক সংযুক্তির প্রতীক। এটি শুধু পরিবহন ব্যবস্থা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের রূপক। বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে যদি আত্মসাৎ, অবহেলা, দুর্নীতি ও নিপীড়নের যন্ত্র বানিয়ে ফেলা হয়, তাহলে এর ক্ষতি শুধু রেল নয়—জাতির।
এই মুহূর্তে দরকার সংস্কার, মানবিক বোধ এবং দক্ষ নেতৃত্বের সমন্বয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ রেলওয়ে গঠন। রেল বাঁচাতে হলে প্রণোদনা নয়, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক শুদ্ধি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি,বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি