বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
06 Feb 2025 04:52 am
পীরগঞ্জ(রংপুর)প্রতিনিধিঃ- আবাদ করি কি করমো ? এবার ভিটা-মাটি বেঁচি সংসার চলা নাগবি,এভাবেই আক্ষেপ করে নিজেদের হতাশা, কষ্ট, যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের কথা জানান সবজি পল্লী এলাকা হিসেবে খ্যাত কাবিলপুর ইউনিয়নের জামালপুর, কৃষ্ণপুর, জয়পুর ও শ্রীরামপুরের কৃষক হামিদুল,জহিরুল,অহেদ আলী, রফিকুল,শাহাবুদ্দিন, বকুল মিয়া, মশিউর,জুয়েল হোসেন, এনামুল আব্দুল জব্বারসহ অনেকে।
কৃষকরা জানান, পৃথক পৃথক জমিতে ফুলকপি,বাঁধাকপি ও সীম আবাদ করা হয়েছে। প্রতি বছরই নানা ধরনের সবজি আবাদ করে থাকি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ফুলকপি ও বাঁধাকপির বিঘা প্রতি চার হাজার চারা রোপনসহ সবজি আবাদে তিনধাপে বিঘা প্রতি ৬০ কেজি ডিএপি, ৭০কেজি ইউরিয়া, ৩ কেজি পটাশ, ২৫ কেজি জিপ, ২ কেজি বোরন সার লাগে।
এছাড়াও বালাইনাশক, কুয়াশাজনিত ছত্রাক ও ভিটামিন স্প্রে করতে হয় কয়েকদিন পর পর। সার ও ওষুধ প্রয়োগে বাজার মূল্যে বিঘা প্রতি সর্বনি¤œ ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা চারা রোপনে খরচ। এছাড়াও হাল-চাষে জমি তৈরী, চারা, পরিবহন ও শ্রম খরচ ধরলে সর্বনি¤œ উৎপাদন খরচ ১০ টাকা। অথচ বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৩ টাকা প্রতি পিস। এ বছর ফুলকপি ও বাঁধাকপির চারা বিক্রি হয়েছে দুই, আড়াই ও তিন টাকায়। ৫০ শতাংশ জমিতে সার ও ওষুধের পাশাপাশি বাঁশ ও সুতলির ব্যবহারে সীম আবাদ করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। ৩দিন পর পর সীমে ওষুধ স্প্রে করতে হয়। অথচ মণ প্রতি সীম দুই’শ থেকে আড়াই’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ বছর ফসলের খরচ উঠবে না, উল্টো লোকসানের বোঝা বাড়বে। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাতেও কস্ট হবে। বিক্রি না হওয়ায় অনেক কৃষক জমি খালি করতে ফুলকপি, বাঁধাকপি তুলে গরুকে খাওয়াচ্ছেন নিয়মিত।
সরলিয়া’র কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, ছেলে আরফানুর ইসলাম রংপুর সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। মেসে থেকে পড়াশোনা করে। মেয়ে নুসরাত জাহান দশম শ্রেণীর ছাত্রী। চাষাবাদে নির্ভরশীল। এ মওসুমে ৩০ শতকে ফুলকপি, ২০ শতকে বাঁধাকপি ২০ শতকে সীম, ২৫ শতকে পিঁয়াজ আবাদ করেছেন। কোন ফসলেই বিক্রি করে খরচ না উঠায় লোকসানে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে শংকিত তিনি। চলতি মওসুমে পীরগঞ্জ উপজেলায় সাড়ে তিনশ হেক্টর জমিতে ফুলকপি, দুইশ হেক্টর জমিতে বাঁধাকপি, আড়াইশ হেক্টর জমিতে বারি, ইকশা দেশীয় জাতের সীম, পাঁচ হাজার নয়শ’ হেক্টর টার্গেট থাকলে আট হাজার দুই’শ হেক্টর রেকর্ড পরিমান জমিতে আলুসহ দুই হাজার এক’শ পঞ্চাশ হেক্টর জমিতে পিঁয়াজের আবাদ হয়েছে।
প্রতি বছর বাঁধাকপি,ফুলকপি, সীম, মুলা,বেগুন, শাখ,টমোটোসহ নানা জাতের নানা ধরনের শীতকালিন সবজি চাষে উপজেলার কাবিলপুরের আজমপুর, জামালপুর, জয়পুর, কেষ্টপুর চতরার কুয়েতপুর, ঘাষিপুর, মাটিয়ালপাড়া রায়পুরের ধুলগাড়ি, নখারপাড়া, চাঁনপুর ও পাঁছগাছির আমোদপুর, কেশবপুর, জাহাঙ্গীরাবাদসহ ৪টি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের চাষীরা সব সময় অনেক এগিয়ে থাকে। বাড়তি লাভের আশায় এসব সবজি চাষ করে অনেকে সাফল্য পেয়েছে।
এছাড়াও উপজেলা অন্যান্য ইউনিয়নে কম বেশি সবজি আবাদ হয়। তবে এবছর ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, সীম, আলু, পিঁয়াজ চাষ করে অধিকাংশ কৃষক লোকসানের মুখে পড়েছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে এসব ফসল যারা আগাম জাত করেছিলেন তারা ভালো দাম পেলেও ভরা মওসুমে বিপাকে পড়েছেন অধিকাংশ কৃষক। অতিরিক্ত লাভের আশায় সবজি চাষ করে লোকসানের বোঝা টানতে হচ্ছে চাষিদের। জমিতে সবজি পচন ধরছে অথচ ক্রেতা সংকট। চারা বা বীজের টাকাও উঠছে না। চাষিদের মাথায় হাত। ফলে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় ফুলকপি,বাঁধাকপি চাষ করে হতাশায় ভুগছেন চাষিরা। উপজেলার সফল কৃষক পরশুরামপুরের সরফ উদ্দিন জানান,প্রতিবছরের ন্যয় এবছরও তিন বিঘা জমিতে পিঁয়াজের আবাদ করেছেন।
ফসল পরিপক্ক হয়ে জমিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে লোকসানের ভয়ে বিক্রি করছেন না, লোকসানের ঘাটতি কমাতে বাজার উর্দ্ধমূখির অপেক্ষা করছেন তিনি। বর্তমান বাজার মূল্য মণ প্রতি ১৪শ’ থেকে সাড়ে ১৪শ’ টাকায় বিক্রি করলে ৩বিঘায় এক লাখ বিশ থেকে দেড় লাখ টাকা লোকসান হবে। ৩ বিঘা জমিতে ৬০মণ বীজ পিঁয়াজ মণ প্রতি ৭ হাজার ৮শ’ ও ৮ হাজার টাকায় কিনে রোপন করেছেন তিনি। বিঘা প্রতি তিন ধাপে ৮০ কেজি ডিএপি, ১০০ কেজি টিএসপি, ৫৫ কেজি পটাশ, ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি জিপ, ৩ কেজি জিংক, ৩ কেজি বোরণ, ৫ কেজি ফুরাটন, ৪ কেজি ভিটামিন নিউট্রি, ৪ কেজি ভিটামিন ফার্মভিট সার প্রয়োগে
খরচ ২০ হাজারের বেশি। আগাছা ও পোকা দমনে বালাইনাশক, কুয়াশাজনিত ছত্রাক ও ভিটামিন ওষুধ নিয়মিত স্প্রে করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫ হাজার। এছাড়াও হাল-চাষে জমি তৈরী, পরিবহন ও শ্রম খরচ ধরলে সর্বনি¤œ উৎপাদন খরচ মণ প্রতি ১ হাজার ৮শ’ ৩৩টাকা। ৩ বিঘায় সর্বনি¤œ তিনশ’ মণ পিঁয়াজ আসতে পারে। লোসানের কথা জানিয়ে কুমারগাড়ীর আব্দুর রশিদ, পলাশ মিয়া, জয়নাল আবেদিন বলেন, পিঁয়াজের বীজ মণ প্রতি কেউ ৪ হাজারে কেউ ১২ হাজার ক্রয় করেছিল। ওই স্কুল শিক্ষক স্টিক, রোমানা পাকড়ি, জাম ও শীলসহ চার জাতের প্রায় ৫ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছে। ২ বিঘা জমির আলু বিক্রি করে ভাল মুনাফা অর্জন হলেও এখন ৩বিঘা জমির আলু নিয়ে বিপাকে।
বর্তমান বাজার মূল্য মণ প্রতি সাড়ে ৬শ’ ও ৬শ’ আশি টাকায় বিক্রি করলে ৩বিঘায় নব্বই হাজারের বেশি লোকসান হবে। বিঘা প্রতি জমিতে ৬ মণ বীজ আলু রোপন করেছেন তিনি। মণ প্রতি ৩ হাজার ৪০ টাকায় বীজ আলু কিনতে হয়েছে। প্রতি বিঘায় তিন ধাপে পিঁয়াজের মতোই ৮০ কেজি ডিএপি, ১০০ কেজি টিএসপি, ৫৫ কেজি পটাশ, ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি জিপ, ৩ কেজি জিংক, ৩ কেজি বোরণ, ৫ কেজি ফুরাটন, ৪ কেজি ভিটামিন নিউট্রি, ৪ কেজি বিভামিন ফার্মভিট সার প্রয়োগে খরচ ২০ হাজারের বেশি। আলুতে ওষুধের প্রয়োগ বেশি। আগাছা ও পোকা দমনে বালাইনাশক, কুয়াশাজনিত ছত্রাক ও ভিটামিন স্প্রে করতে হয়েছে নিয়মিত।
এছাড়াও হাল-চাষে জমি তৈরী, পরিবহন ও শ্রম খরচ ধরলে সর্বনি¤œ উৎপাদন খরচ হয়েছে মণ প্রতি ৮শ’ ৪০ টাকা। ওই এলাকার আলু চাষী আকরাম হোসেন, হাজী আকমল, আলু খ্যাত এলাকা রামনাথপুরের আইনুল, সোহেল রানা, মাসুদ প্রধান, হাসানুর জানান, আলুর ভরপুর মওসুম এখনও আসেনি তাতেই বাজারে দাম নাই, বিক্রিতে লোকসান হচ্ছে, এ বছর বীজ আলুর সংকটে প্রতি কেজি বীজ আলু ৭০ থেকে ১৪০ টাকা কিনেছে। বীজ ক্রয়ে উৎপাদন খরচ অনেকের বেড়ে গেছে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি উদ্যোগে দর ঠিক না করলে চাষিরা পথে বসবেন। কৃষকরা আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে ভবিষ্যতে সংকট তৈরী হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবীদ সাদেকুজ্জামান সরকার জানান, এখন সবজির ভরপুর মওসুম, মুলা, সীম, বেগুন, বাধাকপি, ফুলকপি, টমেটোসহ বাজারে নানা ধরনের সবজি মিলছে, চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি। এছাড়াও কাঁচামাল উৎপাদন বেড়েছে, যে কারনে বাজার গুলোতে সবজির আমদানি বেড়েছে। বাজারজাত করণে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। যে কোন সময় পিঁয়াজের বাজার বেড়ে যাবার আশংকা রয়েছে।
মোঃ আকতারুজ্জামান রানা
পীরগঞ্জ,রংপুর