রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
02 Feb 2025 10:09 pm
৭১ভিশন ডেস্ক:- ২০২২ সালে ‘চ্যাটজিপিটি’ লঞ্চ করে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়া মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওপেন এআই। এরপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বাজারে আধিপত্য বজায় রাখে মাার্কিন কম্পানিগুলোই। গুগলের ‘জেমিনাই’, মেটার ‘লামা,মাইক্রোসফটের ‘কোপাইলট’, অ্যানথ্রপিকের ‘ক্লড’সহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন নতুন সংস্করণ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে। এমনকি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প এআইতে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন।
সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয় ওপেন এআই, ওরাকল ও সফটব্যাংকের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান।একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব উদ্ভাবনকে শাণিত করার পাশাপাশি চীনকে এআইয়ের অ্যাডভান্স প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২২ সালের অক্টোবরে চীনের কাছে এআই চিপ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে ভিন্ন ধরনের এআই চিপও নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেন।
এমনকি বিদায় নেওয়ার আগমুহূর্তেও সেই নিষেধাজ্ঞার আওতা বৃদ্ধি করেন জো বাইডেন। এ নিয়ে টানা তিন বছর এনভিডিয়াসহ মার্কিন কম্পানিগুলোকে এআই নির্মাণে প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক চিপগুলো চীনে রপ্তানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কারণ, চীনের হাতে এমন প্রযুক্তি যাওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জকে অনেকটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই উতরে গেল চীন।
গত ২০ জানুয়ারি চীনা কম্পানি ডিপসিক বাজারে আনে বিশেষায়িত এআই মডেল ‘ডিপসিক আর১’। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে চ্যাটজিপিটিকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপল স্টোরের সর্বোচ্চ রেটিংধারী অ্যাপ্লিকেশন হয়ে ওঠে ডিপসিক। ডিপসিকের আর১ ও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাজারে আসা ভি৩—দুটি মডেলই চ্যাটজিপিটি, জেমিনাইয়ের মতো পশ্চিমা মডেলগুলোর সমান, কিছু ক্ষেত্রে আরো ভালো কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করছে।
স্কেল এআইয়ের সিইও আলেক্সান্ডার ওয়াং সিএনবিসিকে বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, ডিপসিকের পারফরম্যান্স শীর্ষস্থানীয় মার্কিন এআই মডেলগুলোর সমতুল্য।’ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত চ্যাটবট অ্যারেনার এআই র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ১১-এর ভেতর অবস্থান ডিপসিকের দুই মডেল।
সেখানে ইলন মাস্কের ‘গ্রুক’ ও অ্যানথ্রপিকের ‘ক্লড’-এর চেয়ে এগিয়ে আছে তারা।ডিপসিকের দাবি অনুযায়ী, তাদের নতুন মডেলের প্রশিক্ষণে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫৬ লাখ মার্কিন ডলার। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ এআই মডেলগুলো তৈরির পেছনে ১০ থেকে ১০০ কোটি ডলার খরচ হয় বলে দাবি করেছেন অ্যানথ্রপিকের সিইও ডারিও আমোদেই।
স্বল্পোন্নত চিপ ব্যবহার করে কম খরচে এমন উন্নত এআই ডিপসিককে তার দেখা ‘সবচেয়ে যুগান্তকারী উদ্ভাবনগুলোর একটি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট মার্ক আন্দ্রেসেন। ডিপসিকের উত্থান এআই যুগের ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’ বলেও অভিহিত করেছেন তিনি।
ডিপসিকের অ্যাপ ও ওয়েব সংস্করণ, দুটিই ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে। চ্যাটজিপিটির মতো ব্যবহারের কোনো সীমাও থাকছে এতে।
ডিপসিকের সর্বশেষ মডেলটি ওপেন সোর্স; অর্থাৎ এতে ব্যবহৃত কোডগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এআই হার্ডওয়্যার কম্পানি পজিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্যারেট উডসাইড বলেন, ব্যাপারটি সত্যিই অসাধারণ। তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানান, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা ডিপসিক নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেই যাচ্ছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও দ্রুত এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ডিপসিককে আমাদের শিল্প খাতের জন্য একটি সতর্কসংকেত হিসেবে দেখা উচিত। এই প্রতিযোগিতায় জিততে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।’ ডিপসিকের দেখানো পথে মার্কিন কম্পানিগুলো এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ না করে কম খরচেই একই ফলাফল পেতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে ডিপসিক নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে তখন চীনের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আলিবাবা তাদের এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) মডেল কুয়েনের একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সক্ষমতায় চ্যাটজিপিটি ও বহুল আলোচিত চীনা এআই ডিপসিকের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এই সংস্করণ। চীনা নববর্ষের প্রথম দিন কুয়েনের ২.৫-ম্যাক্স মডেলটি উন্মোচন করল আলিবাবা। ফলে দেখা যাচ্ছে শুধু চ্যাটজিপিটি, জেমিনাইয়ের মতো পশ্চিমা এআই মডেলগুলোই নয়, এই খাতে চীনা প্রতিযোগীদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিপসিক। ডিপসিকের-আর১-এর নির্মাতাদের দাবি, তারা এই এআইকে প্রশিক্ষণ দিতে স্বল্পোন্নত এবং কমসংখ্যক কম্পিউটার চিপ ব্যবহার করেছে।
তারা জানিয়েছে, এনভিডিয়ারই আগের এবং স্বল্পোন্নত এইচ৮০০ চিপের মাত্র দুই হাজারটি ব্যবহার করেছে তারা এই মডেলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। এর মানেটা খুব সোজা, নতুন চিপ হয় খুব কাজের নয়, অথবা একই জিনিস নিয়ে কাজ করলে সিলিকন ভ্যালির ‘দানব’দের তারা অচিরেই দেখে নিতে পারবে। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব সুখকর নয়, বলা বাহুল্য। তার ওপর তাদের গবেষণাপত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, চীনের ফার্মগুলো প্রয়োজনীয় পরিমাণ চিপ ঠিকই সংগ্রহ করে নিচ্ছে অথবা সংখ্যায় কম থাকলে তা কাটিয়ে ওঠার মতো সক্ষমতা তাদের আছে। এর মানে, যুক্তরাষ্ট্রের এত সব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞায় আসলে খুব একটা কাজ হয়নি। এই এআইতে ব্যবহৃত এইচ৮০০ চিপও ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর আর চীনে রপ্তানি করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীনের উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক পদক্ষেপ নিলেও লাভ হয়নি। চীন ঠিকই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। ফলে আগামী দিনে এআইয়ের বাজারে যুক্তরাষ্ট্র-চীন লড়াই আরো জমে উঠবে সন্দেহ নেই। কারণ মার্কিন কম্পানিগুলোর পাশাপাশি চীনা কম্পানিগুলোও আরো শক্তিশালী নতুন এআই মডেল আনতে প্রতিযোগিতা করছে।
সূত্র : আলজাজিরা, সিএনএন, এএফপি