শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৫
17 Jan 2025 05:33 am
গল্প লিখতে হলে সত্য ঘটনার কিছু উপকরণ থাকতে হয়।উপন্যাসও তাই, তবে কবি উপন্যাস লিখতে গিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে বিন্দুকে সিন্দু বানান।সম্প্রতি সাংবাদিক ইলিয়াসের ইউটিউবে মেজর ডালিমের মুখ সেরকম গল্প ও উপন্যাস প্রচারিত হয়েছে। ডালিমের মুখে সত্য বাক্যগুলো হলো; ১) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রে পাক সেনারা হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে(তিনি মুখ ফসকে কয়েক লক্ষ বলেছেন); ২) ৭২ এর আগের মুজিব আর ৭২ এর পরের মুজিব এক নয়; ৩) মুজিবের বাড়িতে যাতায়াত ছিল এবং তার স্ত্রী মুজিবের স্ত্রীকে মা সম্বোধন করতেন। মুজিব তাকে তুই সম্বোধন করতেন।
উপন্যাস হলো : ১) মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পালিয়ে দিল্লি আসেন।ইন্দিরা গান্ধী তাকে রিসিভ করেন(!) এবং কর্নেল ওসমানির কাছে পৌছে দেন; ২)বিয়ের অনুষ্ঠানে তার শ্যালকের চুল টানা নিয়ে বিশাল উপাখ্যান হলো -রেডক্রসের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার সশস্ত্র বাহিনী দুইটি মাইক্রোবাসে করে (তখন রেডক্রসের মাইক্রোবাস ছিল না,বড় জীপ ছিল) তার স্ত্রী ও শাশুড়ী সহ তাকে অপহরণ করে( যাক,তিনি শেখ কামালের নাম বলেন নি)।তাকে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।এক পর্যায়ে তিনি গোলাম মোস্তফাকে বলেন তাকে অপহরণ করার ঘটনাটি শত শত মানুষ দেখেছে।ফলে বিষয়টি হজম করা কঠিন হবে।
এ কথা শুনে গোলাম মোস্তফা ঘাবড়ে যান এবং তাকে শেখ মুজিবের ৩২ নং বাড়িতে নিয়ে আসেন।তার অপহরন করার ঘটনাটি চাউর হয়ে গেলে পুরো ক্যান্টনমেন্ট উত্তাল হয়ে পড়ে এবং যে যেই পোশাকেই ছিলেন বেড়িয়ে আসেন।৩২ নং বাড়িতে সেনা প্রধান শফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, কর্নেল নুরুজ্জামান,বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সহ বহু সেনা অফিসার ছুটে আসে।তাদের উপস্থিতিতে মুজিব জোড়াতালি মার্কা বিচার করে।পরে তিনি জানতে পারেন শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাকে সহ ৫ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।তিনি ৭৫ এর নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলেন- এটি একটি সেনা অভ্যুথ্বান, উভয় পক্ষের গুলাগুলিতে শেখ মুজিব মারা গেছেন।৩) জাতির পিতা- মাতা -ভগ্নি বলতে কিছু নেই।যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে- জাতির পিতা আদম (আ:) ( তিনি ইব্রাহিম আ: কে কেন জাতির পিতা বললেন না, তা বোধগম্য হলো না।তবে সাংবাদিক ইলিয়াস আমেরিকাতে প্রচলিত 'ফাউন্ডার' শব্দটি উচ্চারণ করে আমেরিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন)।তিনি বলেন,জিন্নাহ জীবিত থাকতে নিজেকে জাতির পিতা বলেন নি।( বিভিন্ন বই পড়ে যেটা জেনেছি, তা হলো ঐ ঘটনার সময় লেডিস ক্লাবের কাছেই সেনাবাহিনীর শীতকালীন মহড়া হচ্ছিল।সেই মহড়ায় লে.শেখ জামাল ছিলেন।
মেজর ডালিম সেনা ক্যাম্পে গিয়ে ঘটনাটি বললে শেখ জামাল ও শেখ আরিফ লেডিস ক্লাবে আসেন এবং তাদেরকে ৩২ নং এ নিয়ে যান।ঘটনাটি আপোষের পরেও ডালিমের ক্রোধ থামেনি।তিনি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নিজ এলাকার দায়িত্ব নেন।তারপর কুমিল্লার গোলাম মোস্তফার বাড়িতে গিয়ে সকলকে বেধড়ক মারপিট করে (তারা একই এলাকার লোক এবং পরস্পর আত্মীয়।একই কারণে উভয় পরিবার বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়েছিল।তাছাড়া তাদের মধ্যে বংশগত পুর্ব শত্রুতা ছিল।
এ ঘটনা এবং ক্যান্টনমেন্টে মেজর নুর সহ কয়েকজনের ষড়যন্ত্রের কারণে তাদের বরখাস্ত করা হয়)। তবে বলতে হয়,মুক্তিযুদ্ধের পর যে 'সরকার ব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠা পায় নি,এ ঘটনাটি তার বড় প্রমাণ।তাছাড়া বরখাস্তকৃত সেনা অফিসাররা সামরিক পোশাক পড়ে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করে কীভাবে! আবার লেডিস ক্লাবের মারামারির ঘটনাটি তদন্ত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট থানার ওসির। সেটা প্রেসিডেন্টের কাছে আসে কীভাবে?
প্রশ্ন হলো- ক্ষুদ্র ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে এত বড় ঘটনা ঘটাতে হবে, সেটা কোন আইন কিংবা সভ্যতার পর্যায়ে পড়ে? এটা কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সামাজিক প্রেষণা নির্ভর কর্মকাণ্ডের বিপরীতে জৈবিক প্রেষণা নির্ভর কর্মকাণ্ড নয়?
আমরা জানি, সভ্যতার সুতিকাগার গ্রীসের দার্শনিক সক্রেটিস মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়ার পর বলেছিলেন- 'রাজ্যের শৃঙ্খলার স্বার্থে রাজার ভুল আদেশ মেনে নিতে হবে।'মেজর মেজর ডালিম ৭৫ সালে ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রেডিওতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছিলেন।পরে পালিয়ে খৃষ্টান দেশ ক্যানাডায় আশ্রয় নেন।ক্যানাডা সরকার ইংল্যান্ডের রাণী/ রাজাকে মান্য করে এবং ক্যানডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ইংল্যান্ডের রাজাকে নিজেদের রাজা মনে করে।মান্য করাই সভ্যতা।আর যেসব দেশের রাজনীতিকরা অমান্য করার বয়ান শেখায়,কিংবা অমান্য করে হত্যাকাণ্ড ঘটায়,সেসব দেশ এখনো বর্বর দেশের তালিকায় রয়েছে ( যেমন,আরব ও আফ্রিকার কতিপয় দেশ)।তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানকে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়েছেন।
৭৫ এর হত্যাকাণ্ড ও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৩ টি বহুল পঠিত গ্রন্থ আছে, সেগুলোর সঙ্গে তার বয়ানের খুব কম মিল পাওয়া যায়। ইলিয়াস তার ইউটিউবের ভিউয়ের' সংখ্যা দেখিয়েছেন ৭ লাখ।এ নিয়ে এক শ্রেণীর লোক বড়াই করে বহু কিছু বলছেন।৯০ দশকে অশ্লীল কাটপিস মার্কা সিনেমা চালু হয়। যুবক বয়সে ওসব সিনেমা খুব দেখতাম। পরে বুঝেছি,কাটপিস সিনেমার মুল কাহিনির কোনো অংশ নয়।
৭৫ এর ঘটনা নিয়ে যাদের লেখা বই বেশি আলোচিত তাঁরা হলেন- লে.কর্নেল এম এ হামিদ,বিগ্রে.সাখাওয়াত হোসেন,অধ্যাপক আবু সাইয়িদ,জগলুল আলম,এম এ লতিফ,মো. নুরুল আনোয়ার,জাহিদ নেওয়াজ খান,নির্মেলেন্দু গুণ,মে.জে.খলিলুর রহমান,সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান,হামিদ দাদ খান,কর্নেল সাফায়েত জামিল,এম খতিব,এন্থনী ম্যাসকাহারেন্স,লরেন্স লিফশুলৎজ।
আমার কাছে এম এ হামিদের 'তিনটি সেনা অভ্যুথ্বান ও কিছু না বলা কথা' বেশি তথ্য নির্ভর মনে হয়েছে।
লেখক: গবেষক:-মোশাররফ হোসেন মুসা