শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
03 Dec 2024 11:02 pm
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সার্বভৌমত্ব।বাংলাদেশের আয়তন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭৩ বর্গ কি.মি.।এর প্রতি ইঞ্চি জায়গা সার্বভৌমত্বের আওতায় পড়ে।জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিরা প্রতিটি এলাকা সমহারে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয় বটে; কিন্তু ত্রুটিপুর্ণ শাসন ব্যবস্থার কারণে তাঁরা রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মেনে নিতে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের প্রধান কার্যালয় ঢাকা শহরে অবস্থিত।
বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো ঢাকায় অবস্থিত। ঢাকা অচল হয়ে যাওয়া মানে সমগ্র দেশ অচল হয়ে যাওয়া। ঢাকার পতন মানে সরকারের পতন। একই কারণে রাজনীতিও ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকা শহরে প্রবেশের জন্য কতগুলো প্রধান সড়ক রয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরণের আন্দোলন দেখা দিলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়। ঢাকাকে সামনে করে বড় বড় রাস্তা, রেললাইন, সড়কসেতু, রেলসেতু নির্মাণ করা হয়। ফলে সমগ্র দেশটি ঢাকামুখী।
ঢাকামুখী জনস্রোতকে ঠেকানোর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ না করে ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য নানারকম মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যেমন- মেট্রোরেল, উড়ালসেতু, ব্লকভিত্তিক আবাসন প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি। সরকারি পরিসংখ্যানে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ দেখানো হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে ঢাকা শহরে জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। অর্থ্যাৎ দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলে প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ ঢাকা শহরে বাস করে। জনসংখ্যার অধিক ঘনত্বের কারণে সামান্য অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। বিল্ডিং ধ্বসে গেলে চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি সরকার বিরোধী আন্দোলনে( ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার দলীয় ক্যাডারদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে শুধু ঢাকা শহরে ৬৫০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের তালিকায় রয়েছে শিশু, ছাত্র-ছাত্রী, পথচারী, ব্যবসায়ী সহ নিরীহ মানুষ।
আহত হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ - যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক( এখানে উল্লেখ্য, ঘনবসতির কারণে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ যদি ফাঁকা গুলী ছুড়ে তাহলে সেই গুলীও কারো না কারোর বাড়ির জানালা-দরজায় আঘাত করবে)। ৫ আগস্ট বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের দিকে যাত্রা শুরু করলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এ যেন প্রাচীন যুগের রাজার দুর্গ দখলের মতো।
ইউরোপের নগর রাষ্ট্রের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, দুর্গের ভিতর রাজপ্রাসাদ ছিল। তাছাড়া অভিজাত শ্রেণী, সৈন্য বাহিনী, রাজ কর্মচারী, দাসেরা থাকতো প্রাচীর ঘেরা নগরে। দাসেরা দুর্গের বাইরে চাষাবাদ করতো। তবে সৈন্যরা তাদের তেমন নিরাপত্তা দিতো না। নগর দখল ছাড়া রাজ্য দখল হতো না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার পরিবর্তনের নিয়ম থাকলেও অনুন্নত বিশ্বের সরকারগুলো ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। দেখা দেয় আন্দোলন। আন্দোলন যদি সমগ্র দেশব্যাপী হয়েও রাজধানী দখল করতে না পারলে সরকারের পতন হয় না। আন্দোলন যেহেতু রাজধানীকেন্দ্রিক থাকে, সে কারণে তৃণমূল জনগোষ্ঠী তথা সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটে না।
স্বাধীনতার পর প্রণীত সংবিধানে এককেন্দ্রিক সরকারের কথা বলা আছে। বাকশাল ব্যবস্থায় ডিস্ট্রিক্ট গভার্নমেন্ট ব্যবস্থার কথা বলা থাকলেও সেটাকে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলা যায় না। সেটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী বিভাগের বর্ধিত হাত।
একইভাবে এরশাদ সরকারের উপজেলা ব্যবস্থাকেও গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলা যায় না। তবে উপজেলাকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ায়, কেন্দ্রীয় সরকারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অফিসগুলো এক জায়গায় হওয়ায় এবং উপজেলা আদালত ব্যবস্থা চালু হওয়ায় স্থানীয় জনগণ বেশ উপকৃত হয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে উপজেলা ব্যবস্থা বাতিল করে এবং আদালতগুলোকে জেলা শহরে নিয়ে আসে।
২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে উপজেলা ব্যবস্থা চালু করে কিন্তু প্রায় সকল ক্ষমতা উপজেলা প্রশাসনের হাতে রেখে দেয়। সেজন্য বলা হয়, সামরিক সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে স্থানীয় সরকারের হাতে যতটুকু ক্ষমতা দেয়, নির্বাচিত সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে সেটুকু কেড়ে নেয়। তারা হয়ত বিকেন্দ্রীভূত সরকারকে ভয় পায়। বিগত আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে স্থানীয় সরকারকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নানারকম ফন্দিফিকির করে। তারা দলীয় মনোনয়ন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, মেয়র/চেয়ারম্যানদের দলীয় প্রতীকের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ফলে বিরোধী দলীয় প্রার্থীরাই শুধু নয়, স্বতন্ত্র মতের লোকেরাও নির্বাচন থেকে দুরে সরে যান।
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপুর্ণ না হওয়ায় জাতীয় সংসদ কর্মমুখর পরিবেশ হারায়। ফলে রাষ্ট্রের বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় সিন্ডিকেটের আওতায় চলে যায়। জন্ম ঘটে নয়া ফ্যাসীবাদী শাসনের। তবে আশার কথা, সকল মহল থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলা শুরু হয়েছে।
অন্তবর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৬ টি কমিশন গঠন করেছে। তবে মৌলিক দুটি কমিশন তথা অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন ও শিক্ষা কমিশন এখনো গঠিত হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, প্রয়োজনে আরও কমিশন গঠন করা হবে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংস্কারের জন্য ৩১ দফা ঘোষণা করেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক জিয়া ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন একজন ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন করবে। কিন্তু একাধিক সরকার ব্যবস্থা এবং স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দেন নি।
সিডিএলজি'র পক্ষে আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছি দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থাই সমাধান দিতে পারে ।তাহলো কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। জেলা সরকার হবে স্থানীয় সরকারগুলোর সর্বোচ্চ স্তর। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে শুধু জেলা সরকারের সম্পর্ক থাকবে। জেলার ভৌগোলিক ইউনিট থেকে প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষ সৃষ্টি করতে হবে। তার আগে নগরায়নমুখী বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে স্থানীয় সরকারগুলোর স্তর বিন্যাস করতে হবে।
বাংলাদেশে এখন ছোট-বড় প্রায় দুই হাজার হাট-বাজার রয়েছে। কৃষি জমিকে রক্ষা করার জন্য, পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য এসব হাট-বাজার কেন্দ্রিক নগর গড়ে তুলতে হবে। এসব নগরে কর্ম সংস্থানের জন্য শিল্প-কারখানা, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান, বিনোদনের জন্য উপযুক্ত খেলার মাঠ ও পার্ক নির্মাণ করতে হবে। তাহলে শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের স্থানীয়তাকে পরিত্যাগ করে রাজধানী শহরে, বিভাগীয় শহরে ও জেলা শহরে কর্মের জন্য ভীড় করবে না। তাছাড়া জেলা সরকার ব্যবস্থা চালু হলে ছোট ছোট বহু দল জেলা কেন্দ্রিক রাজনীতি ও তাদের কর্মসুচি বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে(সেক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত উদাহরণ হতে পারে)।
আমাদের মতো ছোট বেশ কয়েকটি দেশে একাধিক রাজধানী আছে। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও বাস্তবে সেটার কার্যকারিতা দেখা যায় না। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোরের দিঘাপাতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায়ের রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন নামকরন করেন- যা ঢাকার বাইরে প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র অফিস ও বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। নাটোরবাসী এখানে মন্ত্রী পরিষদের অধিবেশন করার জন্য বার বার দাবী করে আসছেন। তবে এরশাদ সরকার একবার ও ১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকার একবার মন্ত্রী পরিষদের অধিবেশন করেছিলেন।
ছোট দেশ অথচ একাধিক রাজধানী এরকম ১০ টি দেশ রয়েছে। যেমন- শ্রীলঙ্কার রাজধানী দুটি; কলম্বো ও শ্রীজয়াবর্ধনেপুরা কোট্টে। দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী শহর তিনটি; কেপটাউন, ব্লমফেন্টেন ও প্রিটোরিয়া৷মালয়েশিয়ার রাজধানী দুটি; কুয়ালালামপুর ও পুত্রজায়া।নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দুটি; আমস্টারডাম ও দ্য হেগ।ইউরোপের ছোট দেশ মন্টিনেগ্রোর রাজধানী শহর দুটি; পোডরিকা ও সেটিঞ্জে বলিভিয়ার রাজধানী দুটি; লা পাজ ও সুক্রে।আফ্রিকার সোয়াজিল্যান্ডের রাজধানী দুটি; পোর্টোনোভো ও কোটেনা।জর্জিয়ার রাজধানী দুটি ; তিবলিসি ও কুতাইসি৷
কাজেই আমরা যদি সর্বস্তরে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন চাই, তাহলে স্থানীয় সরকারগুলোকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে স্বায়ত্তশাসন দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।
লেখক:মোশাররফ হোসেন মুসা, গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।