বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
10 Nov 2024 05:50 am
৭১ভিশন ডেস্ক:- নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন ‘নোঙর ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেছেন, তিস্তায় পানির ঘাটতির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়।
এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। গবেষণায় আরও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, এ ক্ষতি ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ হতে পারে।
ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির খসড়া হয়েছে, কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি বলে জানান নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন ‘নোঙর ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান সুমন শামস।
গতকাল সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর, সকাল ১১টায়) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত ‘আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাংলাদেশের অধিকার’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
নোঙর ট্রাস্ট সংগঠনের চেয়ারম্যান বলেন, আন্তঃসীমান্ত নদী বলতে সাধারণত সেই সমস্ত নদীকে বোঝায়, যেগুলো অন্তত এক বা একাধিক দেশের রাজনৈতিক সীমা অতিক্রম করে। এই সীমা একটি দেশের অভ্যন্তর অর্থাৎ প্রদেশগত বা আন্তর্জাতিক দুই-ই হতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২৬০টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এবং মিয়ানমার থেকে ৫৭টি মতান্তরে ৫৮টি বা আরও বেশি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
তিনি বলেন, জলতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই এ আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যেমন নদীগুলো প্রচুর পরিমাণে পলি বহন করে এনে মোহনা এলাকায় নতুন নতুন ভূমি গঠন করছে, আবার এ পলির অংশবিশেষ নদীর তলদেশ ভরাট করে তুলছে; যা বন্যার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ নদীগুলোর উজান অঞ্চলের রাষ্ট্র দুটির সঙ্গে অনেক সময়ই নদীর পানি বণ্টনে আন্তর্জাতিক রীতি প্রয়োগ না হওয়ায় দুর্যোগ ও রাজনৈতিক সমস্যার ঘনঘটা হয়।
সুমন শামস বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ৫৫টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে, যার মধ্যে কেবল গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি হয়েছে দুদেশের মধ্যে। ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির খসড়া হয়েছে, কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
তিনি বলেন, তিস্তা অববাহিকায় পানির ঘাটতির কারণে কৃষকরা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে জমিতে সেচ দিচ্ছে। এতে করে কৃষকদের সেচের খরচ অনেকগুণ বেড়ে গেছে এবং কৃষিব্যবস্থাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে যে, উত্তরাঞ্চলের খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এর সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকার সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চলতে থাকলে তা ভবিষ্যতে পুড়ো উত্তরাঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
সুমন শামস বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন আলাপ-আলোচনার পর স্বাক্ষরের জন্য চুক্তির একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানির ৩৭ দশমিক ৫ ভাগ বাংলাদেশের এবং ৪২ দশমিক ৫ ভাগ ভারতের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২০ ভাগ থাকবে নদীর পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। এরপর নরেন্দ্র মোদির সরকার তিস্তার পানি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবুও এক দশকের বেশি সময় ধরে বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। প্রতিবছর ৩১ জানুয়ারি হতে ৩১ মে এই সময়ে ফারাক্কায় প্রবাহিত পানির পরিমাপের ভিত্তিতে দুটি দেশের মধ্যে পানি বণ্টন হবে বলে নির্ধারণ করা হয়। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় মাত্রা অনুযায়ী ভারত গঙ্গার পানির ভাগ পেতে থাকে। তবে সংকটের সময় বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি সরবরাহ করার গ্যারান্টি রয়েছে। ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তি ২০২৬ সালে দুটি দেশের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে নবায়নের কথা।
সুমন শামস বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নির্মিত হয় সোয়া ২ কিলোমিটার লম্বা ফারাক্কা ব্যারাজ। এখান থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে, গঙ্গা-পদ্মার মতো বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। তা সত্ত্বেও ফারাক্কা ব্যারাজটি নির্মাণ করা হয়। এর প্রভাবে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় নেমে আসে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রংপুর বিভাগের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সিকিমে উৎপন্ন তিস্তা নদী বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার প্লাবনভূমি ২ হাজার ৭৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তীর্ণ। লাখ লাখ মানুষ কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, মাছ ধরা এবং গৃহস্থালি দৈনন্দিন পানির চাহিদা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য তিস্তা নদীর ওপর নির্ভর করে। এ নদীতেও উজানে পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিমে বাঁধ, ব্যারাজ, জলবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এই অবকাঠামোগুলো তিস্তার উজানে পানির চাহিদা পূরণ করছে। কিন্তু তা ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীতে পানির প্রাপ্যতা দারুণভাবে হ্রাস করেছে।
এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নদী রক্ষায় নদীসম্পদ মন্ত্রণালয় গঠন করাসহ ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন সুমন শামস।
দাবিগুলো হলো:
১। দেশের স্বার্থে ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭’ অনুস্বাক্ষর করার মাধ্যমে সব অভিন্ন নদীর বাধা অপসারণ করে ফারাক্কা-তিস্তাসহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।
২। আদালতের নির্দেশমতে ১৯৪০ সালের সিএস, এসএ, আরএস, বিএস, ড্যাপ, পরিবেশ এবং জলাধার আইন মোতাবেক সব নদী, খাল, পুকুর, হাওড়বাওড়, জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।
৩। ধলেশ্বরী নদী থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর উৎসমুখে গড়ে তোলা মধুমতী মডেল