শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪
24 Nov 2024 04:12 am
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য অনেকে তাঁর অতিকথনকে দায়ী করেন।তাঁর মুখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ঘটনা দীর্ঘ। সেটা দলের নেতা-কর্মীদের নিয়েও যেমন আছে, তেমনি দলের বাইরের লোকদের নিয়েও আছে।সেই তালিকায় ড.কামাল হোসেন,তোফায়েল আহমেদ, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ, এবিএম মুসা, ড.মুহাম্মদ ইউনুস, প্রেসিডেন্ট জিয়া, খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া,হাসানুল হক ইনু প্রমুখ ব্যক্তিসহ বহু প্রখ্যাত ব্যক্তিও রয়েছেন।কিন্তু তাঁর এসব আচরণের পিছনের কারণটা অনেকে খুুঁজেন না।এর পিছনে রয়েছে সামন্ত মনোভাব।সামন্ত মনোভাব বুঝার আগে আমাদেরকে সামন্ততন্ত্র বুঝতে হবে।
মধ্যযুগে কেন্দ্রীয় সরকারের শিথিল শাসনব্যবস্থার কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুস্বামীদের শাসন শুরু । তাঁদেরকে মহারাজা, রাজা, রায়, মালিক, চৌধুরী, নবাব, খান প্রভৃতি নামে উপাধি দেয়া হতো। সামন্ত রাজারা খাঁজনা আদায়ের পাশাপাশি জনগণের নিরাপত্তাও দিতো। তাঁদের হাতে বিচারিক ক্ষমতা ছিল।
জনগণ তাদেরকে রক্ষাকর্তা মনে করতো।অনেকে প্রভু হিসেবেও মান্য করতো। উদাহরণ হিসেবে নাটোরের রাণী ভবানীর নাম উল্লেখ করা যায়।তিনি বাংলার তের চাকলার এক চাকলার মালিক ছিলেন। তাঁদের অধীনে ছোট ছোট জমিদার থাকতেন। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালু হলে জমিদারীদাররা জমির স্থায়ী মালিক হয়ে যান।জমিদারের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি ছিল। জমিদাররা তাদের খাঁজনা আদায়ের স্বার্থে বহু সংখ্যক জোতদার শ্রেণী সৃষ্টি করে।আমরা যাদেরকে জমিদার হিসেবে চিনি , তারা অনেকেই ছিলেন মূলত জোতদার।তখন জমিদার-জোতদাররা জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন।
জমিদার প্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেছে বহু কাল আগে ;কিন্তু সামন্ত মানসিকতা রয়ে গেছে আমাদের মাঝে। আমরা এখনো যারা উৎপাদন সঙ্গে জড়িত তথা কৃষক, তাতি,খুলু, জেলে,চর্মকার, কামার,কুমোর ইত্যাদি পেশার সঙ্গে জড়িত তাদেরকে সম্মান দেই না।কখনো বলি না আমার বাবা কিংবা দাদা চাষী ছিলেন।বলি না তাতী ছিলেন। শেখ হাসিনার মুখে একাধিকবার শোনা গেছে তাঁর পুর্ব পুরুষরা ইরাক থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলায় এসেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা আশরাফ গোত্রের।
দলের সভানেত্রী সামন্ত মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় তিনি কখনো দ্বিমত পছন্দ করতেন না।ফলে তাকে ঘিরে অনুগত নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, পুলিশ বাহিনীর এক দুর্ভেদ্য চক্র গড়ে উঠে। সভানেত্রী যেখানে সামন্ত মনোভাব দ্বারা পরিচালিত, সেখানে দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে জনবান্ধব আচরণ আশা যায় কীভাবে! এমন একজন মন্ত্রীকে চিনতাম যার সমস্ত কথার মধ্যে থাকতো বংশ গৌরব(অথচ তাঁর পিতা মাত্র ৩০ বিঘা জমি রেখে মারা গিয়েছিলেন )।তার কাছে গিয়ে অপমানিত হননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার মুখে কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শোনা যেতো না।তার এক অনুসারীকে চিনি, তার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা ;অথচ তিনি তার নানার পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।এরকম উদাহরণ লক্ষ লক্ষ রয়েছে। আমির হোসেন আমুর কাছে কেউ গেলে পায়ে কদমবুসি বাধ্যতামূলক ছিল।শুধু তাই নয় রাজা-বাদশার আমলের মতো তাকে সামনে করে সালাম দিতে দিতে পিছাতে হবে; অর্থ্যাৎ পশ্চাৎদেশ প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ।
সামন্ত মনোভাব থেকেই পরিবার তন্ত্রের উদ্ভব হয়। দলের নেত্রী ৩৫ জন আত্মীয়কে এমপি বানিয়েছিলেন, তাঁর দেখাদেখি সমস্ত দেশে পরিবারতন্ত্র বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়। পিতা এমপি, পুত্র পৌর মেয়র, ভাগ্নে চেয়ারম্যান।এখন প্রশ্ন হলো- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কি কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো পরিবারকে প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিল? সেই যু্দ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতিত হন নি, এমন পরিবার এদেশে নেই।আমাদের দুর্ভাগ্য যে, শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় এবং কাঙ্ক্ষিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন না হওয়ায় আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার কোনোটাই পাইনি। একই কারণে সামন্ত মানসিকতারও বিলুপ্তি ঘটেনি।
আমি এক সময় ৬০ জন আওয়ামীলীগ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপর জরিপ চালিয়ে ছিলাম। আওয়ামীলীগ নেতাদের সারাদিনের কথার মধ্যে থাকে বংশগৌরব আর পরনিন্দা।পক্ষান্তরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের আচরণে থাকে আওয়ামীলীগ নেতাদের প্রতি বেয়াদবী। আওয়ামীলীগ নেতারা ভুলে যান যে, এদেশের ৯০% মানুষের কোনো বংশগৌরব নেই৷ তাহলে কি তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক? শুধু আওয়ামীলীগ কেন সকল দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে কম-বেশি সামন্ত মনোভাব রয়েছে।আমরা আরও ভুলে যাই যে, আমাদের বংশের বয়স দুই শ বছরের বেশি নয়।
কারণ বিভিন্ন মহামারীর কারণে বহু বংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বড় পরিবার গড়ে উঠার কোনো পরিবেশ ছিল না।পরিশেষে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ' বংশগৌরব' নামক ছোট গল্পের সারাংশ তুলে ধরা যেতে পারে।চারণ বাবু একটি সওদাগিরি অফিসে কারণিক পদে চাকরি করেন।কিন্তু তিনি যখনই সময় পান, তখনই বানিয়ে বানিয়ে ঠাকুরদার জমিদারি আমলের গল্প বলা শুরু করেন।গল্পের শুরুতে কবি বলেছেন- বাঙালিদের নামে একটি কথা বড়ই প্রচলিত যে,তারা বর্তমানে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন,অতীতের গৌরব গায়ে মেখে নিজেকে মহিমান্বিত করে থাকেন।তা যদি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বাড়িয়ে শোনানো যায়, তা কী এমন দোষের!
লেখক: মোশাররফ হোসেন মুসা,গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।