শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪
23 Nov 2024 03:51 am
৭১ভিশন ডেস্ক:- সরকারি কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতির শাস্তি নিশ্চিতের আইন ও বিধি গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে শিথিল করা হয়েছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দুই সরকারই এ সংক্রান্ত আইন-বিধি সংশোধন করেছে।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা (১৯৮৫) সংশোধনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তি হিসেবে তাকে ‘তিরস্কার’ অন্তর্ভুক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। এই সংশোধনীর আগে এই শাস্তি ছিল ‘বাধ্যতামূলক অবসর’, ‘চাকরি থেকে অপসারণ’ বা ‘চাকরি থেকে বরখাস্ত’।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ সংশোধনের কারণে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের শাস্তির মাত্রা কমেছে। ফলে সরকারি কর্মচারীদেরকে দুর্নীতি-অনিয়মে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে।
১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (ডিমিসাল অন কনভিকশন) অধ্যাদেশের পরিবর্তে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করে সরকারি কর্মচারীদের দায়মুক্তি দিয়েছে সরকার।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, দুর্নীতিবিরোধী নিয়ম-নীতি শিথিল করা হলে দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তদন্তে একজন সরকারি কর্মচারীর দুর্নীতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তিনি কেন চাকরিতে থাকবেন? কেন অন্য কর্মকর্তারা দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির পাশাপাশি কাজ করবেন? সহকর্মীরা কী বার্তা পাবেন? দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জবাবদিহি এড়াতে সুযোগ তৈরি করার বদলে সরকারের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কঠোর দুর্নীতি দমন বিধি প্রণয়ন করা উচিত।
বর্তমান সহকারী সচিব প্রমথ রঞ্জন ঘটক ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মাদারীপুরে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা থাকাকালে পদ্মাসেতুর জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পাঁচজন জমির মালিককে টাকা দেওয়ার নাম করে ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, প্লটগুলো সরকারের মালিকানাধীন।
এজন্য প্রমথ রঞ্জনকে সিনিয়র সহকারী সচিব পদ থেকে সহকারী সচিব পদে পদাবনতির শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফিরোজ মিয়া বলেন, প্রমথ যে অপরাধ করেছেন তার সঙ্গে এই শাস্তি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জবাবদিহি এড়াতে সুযোগ তৈরি করার বদলে সরকারের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কঠোর দুর্নীতি দমন বিধি প্রণয়ন করা উচিত- জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া।
বগুড়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) বীর আমির হামজাকে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায ১২ মাসের জন্য বেতন কমিয়ে দেয় সরকার। দুর্নীতির এই লঘু শাস্তিতে অবাক হয়েছিলেন অনেকে।
অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন, ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (ডিমিসাল অন কনভিকশন) অধ্যাদেশের পরিবর্তে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করে সরকারি কর্মচারীদের দায়মুক্তি দিয়েছে সরকার।
১৯৮৫ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করতে হতো। তবে ২০১৮ সালের আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে ১২ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হওয়ার পরও কোনো কর্মকর্তা- কর্মচারী চাকরিতে থাকতে পারবেন। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি-১৯৭৯ এর ২০০২ সালের সংশোধনী এর আরেকটি উদাহরণ। বিধিমালার ১৩ ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবছর সম্পদের হিসাব নিজ দপ্তরে জমা দেওয়ার বিধান ছিল (যদিও বাস্তবায়ন হতো না)।
এরপরও ২০০২ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে বিধিমালা সংশোধন করায় এখন প্রতি ৫ বছর পর পর কর্মচারীদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান করা হয়েছে, এটাও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কার্যত, সরকারি কর্মচারীরা তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া নিয়ে মাথাই ঘামান না।
দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
উপরন্তু এই বিধান আরো শিথিল করার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি সংশোধন করে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান বাতিলের চিন্তা চলছে। প্রয়োজনে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী সংগ্রহ করার বিষয়টি বিধিমালায় যুক্ত করে নতুন বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
সংবিধানে বলা হয়েছে, কোনো নাগরিক যেন অবৈধ সম্পদ অর্জন করতে না পারে সেজন্য সরকার আইন প্রণয়ন করবে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিশেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবেন না...।
গত ২৫ জুন কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ জাতীয় সংসদে বলেছেন, সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ অপরাধী সুরক্ষার আইন হিসেবে পরিণত হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করে দেখা উচিত।
ডেইলি-বাংলাদেশ