শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪
24 Nov 2024 01:08 pm
শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ:- আমরা কোথায় গেলে একটু সাহায্য পাবো, কোথায় গেলে আমাদের ঘর বাঁচাতে পারবো, কোনো দিশা পাচ্ছি না।সবখানে কুকুর-বিড়ালের মতো আমরা যাচ্ছি।’-মিরনজিল্লা সিটি কলোনীর ঘর হারানো পূজা রানী দাসের কান্নাজড়িত কথাগুলো আমাদের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে।
স¤প্রতি বাংলাদেশের পুরান ঢাকার বংশালের আগাসাদেক রোডের পাশে মিরনজিল্লা হরিজন কলোনীতে উচ্ছেদের ঘটনা সবারই কম-বেশি জানা। বুলডোজারের সামনে স্কুল ড্রেস পরিহিত শিক্ষার্থীদের অবস্থান সত্যিই বিবেককে নাড়িয়ে দেয়।গত সপ্তাহ দু’য়েক হলো ভুক্তভোগী হরিজন হাজারো নারী-পুরুষ,আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার আহাজারিতে মিরনজিল্লার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।হাতজোড় করে সরকারের নিকট মাথা গোঁজার ঠাঁই চাওয়ার দৃশ্যটি বিশ্ব মানবতাকে এক অসহায়ত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়।কম কষ্টে একজন মানুষ বলে না যে, ‘আমাদেরকে চিড়িয়াখানায় ভরে রাখেন।অন্তত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে মানুষ আমাদের দেখতে আসবে।এই আবেগগুলোকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সারা বিশ্ব যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে সেই সময়টাতে আমাদের দেখতে হচ্ছে, মানবিকতা কতটা ভূলুণ্ঠিত। মানুষ কতটা অসহায় আর জীবন কতটা সংকটাপন্ন।
ভারতের নানা অ ল থেকে আনা হয়েছিল এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন, চা বাগান, রেলের কাজসহ বিভিন্ন কাজের জন্য। বলা হয়েছিল তাদের চাকুরীর নিশ্চয়তা থাকবে, সাথে মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু কালক্রমে এখন বাংলাদেশের দলিত জনগোষ্ঠীর বিশেষত হরিজন স¤প্রদায়ের মানুষ এমন একটি সংকটপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে সেই প্রতিশ্রæতি পূরণের লেশমাত্র নেই। ভালোভাবে বেঁচে থাকাটা তাদের জন্য দুঃস্বপ্নের আরেক নাম। আর জাতপাত বৈষম্যের কথা নাই বা বললাম। তারা সমাজের নিচু তলার মানুষ, অচ্ছ্যুৎ, অস্পৃশ্য।
জাতপাতের নির্মমতা বুঝতে হলে হরিজন জীবন বুঝতে হবে। এখনও পরিচয় জানলে কেউ তাঁদের ঘরভাড়া দেয় না। এমনকি রেস্তোরাঁ-হোটেলেও তাঁদের প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আছে।অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলধারার সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসবে হরিজনদের নিমন্ত্রন করা হয় না। এভাবেই মূল¯্রােত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চরম নির্মমতা আর অবজ্ঞা মেনে নিয়েই তারা জীবন চক্রে ঘুরপাঁক খায়।অনেকটা বাধ্য হয়েই বংশ পরম্পরায় পরিচ্ছন্নতার কাজের সাথে যুক্ত এই সম্প্রদায়। পেশা পরিবর্তনের চিন্তা অনেকটাই বিলাসিতা। হরিজনের সন্তান হরিজনের কাজ করে জীবন কাটিয়ে দিবে, যেন এমনটাই অলিখিত নিয়ম। এই সমাজ এখনও তাদের সেই দৃষ্টিতে দেখতে ব্যর্থ, সাম্য আর মানবিক হওয়ার জন্য যেটি আবশ্যিক।হরিজনদের চাকরীতে এখন আউটসোর্সিং শুরু হয়ে গেছে।
আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যখন নিয়োগ হবে তখন তারা আর সিটি করপোরেশন কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কর্মচারী থাকবে না। ফলে তাদের আবাসন ও আনুসাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে শুভঙ্করের ফাঁকি থেকেই যাবে।আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে শুধু হরিজনরাই কাজ করত। কিন্তু গত কয়েক বছরে মুসলমানসহ অহরিজনরাও এই পেশায় যুক্ত হয়েছে।মজার বিষয় হলো, অহরিজনরা তাদের চাকরী মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিলেও কাজটা করিয়ে নেয় কোনও এক জাত-হরিজনকে দিয়েই। পরিচ্ছন্নতা কাজের বিনিময়ে নামমাত্র অর্থ হরিজনকে দিয়ে মোটা অংকের বেতন নিজের পকেটে ভরার উদাহরণ ভরি ভরি।
মিরনজিল্লা হরিজন কলোনীর প্রবেশপথেই একটি স্মৃতিফলক চোখে পড়ে। যেটি মূলত ১০ হরিজন শহীদের নামে করা। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর এখানকার দশজন হরিজনকে রাজাকারদের ইন্ধনে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার কারণে। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরেও কেন তাদের স্বীকৃতি মিলেনি তা এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। তবুও প্রতিবছর পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় অগ্রজদের স্মরণ করেন স্থানীয় হরিজনসহ মুক্তিকামী মানুষেরা। হরিজন সূর্যসন্তান মহাবীর লাল সামুন্দ, নান্দু লাল, আনোয়ার লাল, ঈশ্বর লাল, খালবাল দাস, ঘাশিটা দাস, শংকর দাস হেলা, লালু দাস ও রামচরণরা এই দেশকে নিজের মনে করে জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হন নি। কিন্তু তাদের উত্তরসূরীদের সাথে এমন বিমাতা সুলভ আচরণ কতটা শোভনীয়? জানিনা এর উত্তর কি আর কেইবা দিবেন?
‘মিরন বাঈ’ নামে একজন নামকরা বাঈজী মূলত এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তিনিই এটা হরিজনদের দিয়ে যান। মূলত এটিই ‘মিরনজিল্লা’ নামকরণের প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর এ কলোনীর নিয়ন্ত্রণ যায় সিটি করপোরেশনের হাতে। বর্তমান মিরনজিল্লায় প্রায় ৪০০ বছর আগে হরিজনদের পূর্বপুরুষদের পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য আনা হয়। তারপর থেকেই তারা এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। তাদের বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, এমনকি ভোটার আইডি, পাসপোর্ট নম্বরসহ যাবতীয় নথিপত্রে উল্লেখমতে এই কলোনীই তাদের ঠিকানা। তারপরেও কিভাবে তাদের অবৈধ বলা যায়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
মিরনজিল্লা হরিজন কলোনীর শেকর খুঁজতে গেলে অনেক আগে থেকেই শুরু করতে হবে। এর সাথে ‘হরিজন সেবক সমিতি’ অতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা একটি সামাজিক সংগঠন। ১৯৪১ সালে এই মিরনজিল্লাতেই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা পায়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব থেকেই জাত-হরিজনদের বাস এখানে। ১৮৬৪ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠা পাবার পর এটি ১৯৭৮ সালে সিটি কর্পোরেশনে পরিবর্তিত হয়। সেই থেকে আজ অবধি হরিজনরা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজের সাথে জড়িত। যারা যুগের পর যুগ শহর সাফ (পরিষ্কার) করেছেন, আজ তাদেরই সাফ (নিশ্চিহ্ন) করে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় সাত শতাধিক পরিবারের ১০ বাই ১০ ছোট্ট ঘরে তিন প্রজন্মের গাদাগাদি বাস এখানে। পুত্র, কন্যা, পুত্রবধু এমনকি নাতি-নাতনী নিয়ে একটি কক্ষে কিভাবে বাস করা সম্ভব? এই অসম্ভবকে সম্ভব করেই চলছে হরিজনদের জীবন।
হরিজন সেবক সমিতি গত ৬ মে ২০২২ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়রের বরাবর একটি দরখাস্তের মাধ্যমে কলোনীর মানুষের কষ্টের কথা উল্লেখপূর্বক টিনের ঘরগুলো ভেঙ্গে ১০তলা বিশিষ্ট ৫টি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে মেয়র ফজলে নূর তাপস ‘পর্যালোচনা করে পেশ করুন’ বলে স্বাক্ষর করলেও বিগত ২ বছরে পর্যালোচনার ফলাফল শুন্য।
এরইমধ্যে মৌখিকভাবে মিরনজিল্লা কলোনীর ঘর ভাঙ্গার আদেশ দিলে হরিজন নেতৃবৃন্দ সিটি করপোরেশনে কর্মকর্তাদের কাছে জানতে যান। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, এসব মেয়র সাহেব জানেন। মেয়র আদেশ দিয়ে বিদেশে গেছেন। ৮ জুন দেশে ফিরে ৯ জুন তিনি নতুন বিল্ডিংয়ে যারা চাকুরী করে তাদের ঘর বুঝিয়ে দেবেন। ১০ জুন মিরনজিল্লা টিনসেডের ঘরগুলো উচ্ছেদের কাজ পরিচালনা করবেন। এমন খবরে মিরনজিল্লা কলোনীবাসীর চোখে ঘুম আর স্বস্তি উধাও হয়ে যায়। পাশাপাশি কলোনীতে কিশোর গ্যাং এবং মাদকের আখড়া গড়ে ওঠার মিথ্যে অজুহাতে হরিজনদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। ডিএসসিসিতে কর্মরত কেবলমাত্র ৬৬ জনকে পুনর্বাসন করা হবে, বাকিদের উচ্ছেদ করে বাণিজ্যিকভাবে কাঁচাবাজার নির্মাণের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ঘর বরাদ্দ করা হলেও বাদবাকিদের দিকে তাকিয়ে চাবি নেননি তারা। এই সহমর্মিতা সত্যিই শিক্ষণীয়।
ঢাকার যানজট সমস্যা, অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, মশক নিধনসহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনও সমাধান দিতে না পারলেও অসহায় হরিজনদের উচ্ছেদে ডিএসসিসি’র আগ্রহের কমতি নেই। দূর্বলের উপর সবলের অত্যচার। যারা ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, তাদের প্রতি এই নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ কেন? অথচ তো এই শহরেরই বাসিন্দা, সিটি করপোরেশনেরই ভোটার, এ দেশেরই নাগরিক। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য আমরা সমঅধিকার চাই। পুনর্বাসন না করে কাউকে উচ্ছেদ করা আইন বিরুদ্ধ। হরিজনরা একদিন নগর বা অফিস পরিষ্কার না করলে পরিস্থিতি কতটা দুঃসহ হবে, একবারের জন্যও কি ভেবে দেখেছেন?
মিরনজিল্লা বস্তি উচ্ছেদে গত ৩ ও ৪ জুুন চার প্লাটুন পুলিশ চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর প্রথম চিঠি দেওয়া হয় ডিএসসিসি থেকে। ৬ জুন ‘মিরনজিল্লা উচ্ছেদ, চলবে না, চলবে না’ ¯েøাগানে উত্তাল হয় নগর ভবনের চারপাশ। মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল সহকারে নগর ভবন ঘেরাও করেন কয়েক হাজার হরিজন। মেয়র দেশের বাইরে থাকায় ডিএসসিসি’র পক্ষ থেকে হরিজনদের দাবি ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হয়।
৯ জুন মেয়রের পক্ষ থেকে কলোনী উচ্ছেদ না করা করার আশ^াস দিলেও তা মানা হয়নি। ভবন নির্মাণের জন্য ২০টি ঘর উচ্ছেদের কথা বললেও পরদিন (১০ জুন) ৮০টি বসতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা তিনটি ঘরকে একটি এবং চারটি ঘরকে দুটি ধরে গণনা করে। ওই সময় হরিজন বাসিসন্দারা ঘর খালি করতেও পারেননি। দুশ্চিন্তায় কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েন সেখানে। তখন এমন এক অবস্থা যে তারা আহতদের সামলাবে নাকি ঘরের জিনিসপত্র। হরিজনরা ভাবতেও পারেনি যে তাদের সঙ্গে কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ করা হবে। উপায় না পেয়ে নারীরা মিলে বুলডোজারের সামনে শুয়ে-বসে পড়েন। তাদের কথা- হয় আমাদের এখানে মাটি দেন, না হয় মৃত্যু দেন। উচ্ছেদ হওয়া লোকজন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
১১ জুন আবার উচ্ছেদ করতে আসলে বাধ্য হয়ে স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীদের বুলডোজারের সামনে শুইয়ে দেয় মায়েরা। তারা প্রত্যেকেই স্কুলের পোশাকে প্রতিবাদে শামিল হয়, চোখে কালো কাপড় বাঁধা, হাতে পোস্টার।অনেকেই রাস্তায় বসে ও শুয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।তাদের শেষ আশ্রয়টুকু রক্ষার জন্য হাত জোড় করে মিনতি করে আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকুতি জানায়।ফলে হরিজন স¤প্রদায়ের বাসিন্দা ও তাঁদের স্কুলপড়–য়া সন্তানদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হন তাঁরা।
কলোনি উচ্ছেদের প্রথম দিনে (১০ জুন) উচ্ছেদে ভীত হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় লক্ষি রানীর।একইভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভবন দাস।ঘর উচ্ছেদ করায় ১১ জুন মনের কষ্টে প্রকাশ্যে নিম গাছে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় শাম্মী দাস।লক্ষী রানীসহ নিহত ও আহতদের দায় সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কিভাবে এড়াতে পারেন? কলোনীর পরীক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যহত হবার দায় কে নিবে?
১২ জুন রাতে ডিএসসিসি’র উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মেয়রের সঙ্গে হরিজন স¤প্রদায়ের একটি প্রতিনিধি দলের অনলাইন বৈঠক হয়। পরদিন ১৩ জুন ৪৮ ঘণ্টার সময় বেধে দেয় কর্তৃপক্ষ। সিটি করপোরেশন থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জায়গা খালি করে দিতে বলা হয়।
আশার খবর হলো, উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার ওপর ৩০ দিনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে ১৩ জুন আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আগামী ২১ জুলাই এ বিষয়ে পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে। তাতে করে আপাতত হরিজনদের উচ্ছেদ করা যাবে না।খবরটি কিছুটা স্বস্তি দিলেও চিন্তামুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই মোটেও।দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া হরিজনদের আন্দোলন ছাড়া আর বিকল্প নেই।
সরকারি দলের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার ছিল, অনগ্রসর হরিজন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও তাঁদের বাসস্থানের মতো বিষয়ের উন্নতিতে সরকার অগ্রগণ্য ভ‚মিকা পালন করবে।তাছাড়া বস্তি উচ্ছেদ মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে যে পুনর্বাসন ছাড়া কোনো বস্তি বা কলোনি উচ্ছেদ করা যাবে না। তাহলে হরিজনদের বসতি কেন উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অনাকাক্সিক্ষত সবকিছুর দায় মেয়রকে নিতে হবে। জনগণের করের টাকায় কেনা এই বুলডোজার বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কতটা লজ্জ্বার, কেউ কি ভেবে দেখেছেন?
মিরনজিল্লা উচ্ছেদের ঘটনা এখন আর স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই।রাজধানী ঢাকার গÐি পেরিয়ে সারাদেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মানবিক সংগঠক এবং সংগঠনসমূহ।এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে স্মারকলিপি দিয়েছেন ‘ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ’।কেবলমাত্র দলিত-হরিজন ঘরানার সংগঠনই নয়, বরং মূলধারার রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক,মানবাধিকার ভিত্তিক এবং সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো প্রায় প্রতিদিনই এমন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।প্রকাশ করছেন হরিজনদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংহতি।
উচ্ছেদের ঘটনায় ৫৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।সরেজমিন পরিদর্শন করে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।উচ্ছেদের আগে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার আহŸান জানিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু।
সর্বশেষ ২০ জুন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার-হাজার দলিত-হরিজনদের সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন ভূক্তভোগীরা। আমরা মনে করি চট্টগ্রামের ব্যাটারী গলির রবিদাসপল্লী, রাজধানীর গোপীবাগ, ধলপুর, গোবিন্দগঞ্জের বাগদাফার্মসহ অগণিত উচ্ছেদ প্রক্রিয়া একই সূত্রে গাঁথা। সঙ্গত কারনেই সবারই এগিয়ে আসা উচিত। এটি কেবলমাত্র হরিজনদের সমস্যা নয়, বরং দেশের জাতীয় সমস্যা বিবেচনায় স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সময়ের দাবী।
আমরা দেখেছি, ২০১৯ সালে রেলের জমি স¤প্রসারণের উদ্দেশ্যে রাজধানীর গোপীবাগ (টিটিপাড়া) ও ধলপুরের তেলেগু কলোনি উচ্ছেদ করা হয়। তবে সেখানে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করা হয়নি।একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে মিরনজিল্লাতে, এমন আশঙ্কা হওয়া অমূলক নয়।
গত দেড় দশকে উন্নয়নের নাম করে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই উচ্ছেদগুলোর অভিজ্ঞতা জানান দেয়, এই জনস্বার্থবিরোধী গোষ্ঠীভিত্তিক উন্নয়ন উচ্ছেদকৃত জনগণকে কেবল নিঃস্ব করেছে।মিরনজিল্লা সুইপার কলোনিতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। হরিজন স¤প্রদায়ের মানুষকে বসবাসরত জমির মালিকানা দলিল প্রদান করার মাধ্যমে মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেসময়ে গৃহহীনদের গৃহ উপহার দিচ্ছেন, সে সময়টাতে দেশের সেবাদানকারী হরিজন জনগোষ্ঠী গৃহহীন হবেন কেন? পরিশেষে ভূক্তভোগী হরিজনদের সাথে সুর মিলিয়েই বলতে চাই, ‘হরিজনরা কি মানুষ না? এদেশের নাগরিক না? রোহিঙ্গাদের যদি জায়গা হয়, তবে ৪০০ বছর ধরে সেবা দিয়েও হরিজনরা কেন উচ্ছেদের শিকার হবে?’
লেখক: সংগঠক ও মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মী।