বুধবার, ১২ জুন, ২০২৪
22 Nov 2024 11:56 am
৭১ভিশন ডেস্ক:-ইসরাইলের এসদে তেইমান বন্দিশিবিরে আটক ফিলিস্তিনিদের নিপীড়ন-নির্যাতন ও তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহারের রোমহর্ষ চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসের একটি তদন্তে। তদন্তটি তিন মাস ধরে চালানো হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে ফিলিস্তিনি বন্দিদের উপর অমানুষিক ও বর্বর নির্যাতনের কতা।
স্মরণ করা যেতে পারে, ক্যারিবিয় সাগারে নির্মিত কুখ্যাত মার্কিন কারাগার গুয়ানতানামো বে কারাগারের কথা নির্যাতনের কথা। যে কারাগারকে বলা হয় পৃথিবীর নরক! একই সাথে ইরাকের আবু গারিব কারাগারের কথা। যেখানে ইরাকের সাধারণ বন্দিদের ওপর অমানিসক নির্যাতন চালিয়েছিল মার্কিন সেনারা। পৃথিবীতে এমন অন্তত ১৫টি কুখ্যাত কারাগার রয়েছে। যেখানে সাধারণ বন্দিদের ওপর চলে অসহ্য নির্যাতন।
তবে, ইরসাইলের এসদে তেইমান কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের নির্যাতনের চিত্র এসব কুখ্যাত কারাগারকেও হার মানিয়েছে। যা এই সভ্য সমাজের সুস্থ মস্তিস্কের মানুষের দ্বারা করা সম্ভব নয়। বর্বর ইসরাইলি তাই করছে, যার বর্ণানা শুনলে গা শিউরে উঠবে।
ইসরাইলের ওই বন্দি শিবিরের সাবেক বন্দী, ইসরাইলের সামরিক কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও সেনাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই নির্যাতনের তদন্তকাজ পরিচালনা করা হয়েছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শিবিরটিতে বন্দী আছেন চার হাজারের মতো ফিলিস্তিনি।
এসদে তেইমান বন্দিশিবিরের অবস্থান দক্ষিণ ইসরাইলের একটি সামরিক ঘাঁটিতে। শিবিরটি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরাইলি সেনাদের হাতে আটক হওয়া লোকজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের কাজে ব্যবহৃত একটি অস্থায়ী স্থাপনা।
ইসরাইলি আইনে 'বেআইনি যোদ্ধা' এই বন্দীদের বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ৭৫ দিন পর্যন্ত ও কোনো আইনজীবী বা বিচারের মুখোমুখি করা ছাড়া ৯০ দিন পর্যন্ত আটকে রাখার বিধান আছে। তাঁদের অবস্থান সম্পর্কেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, এমনকি আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটিকেও জানতে দেয়া হয় না; যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তদন্ত চলাকালে শিবিরটির সাবেক বন্দীরা ইসরাইলি সেনাদের হাতে বেধড়ক মারপিট, বৈদ্যুতিক শক, অমানবিক আচরণ, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়ার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদকালে তাঁদের ঘুষি ও লাথি মারা হয়েছে। পেটানো হয়েছে লাঠি-রাইফেলের বাঁট ও ধাতব দ্রব্য শনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র দিয়ে।
এই বন্দীদের অন্তত আটজন ওই শিবিরে আটক ছিলেন বলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে। তাঁরা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময়, তাঁদের ঘুষি ও লাথি মারা হয়েছে। পেটানো হয়েছে লাঠি-রাইফেলের বাঁট ও ধাতব দ্রব্য শনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র দিয়ে।
সেনাদের মারধরে পাঁজরের হাড় ভেঙে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন দুজন বন্দী। তাঁদের একজন দাবি করেছেন, তাঁকে হাঁটু দিয়ে বুকে আঘাত করা হয়েছেন। অন্যজন বলেছেন, তাঁকে লাথি দেওয়া হয়েছে এবং রাইফেল দিয়ে মারা হয়েছে। আর অন্তত সাতজন বন্দী বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের শুধু ডায়াপার পরে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক শক দেয়ার কথাও বলেছেন তিনজন বন্দী। ঠিক একইভাবে বৈদ্যতিক শক দিয়ে নির্যাতন চলত গুয়ানতানামো বে, বা আবু গারিবের কুখ্যাত কারাগারে।
টাইমসের এ তদন্তে যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের একই চিত্রও উঠে এসেছে। এমন নির্যাতনের শিকার হওয়া বন্দীদের একজন জ্যেষ্ঠ নিজের দুঃসহ স্মৃতির কথা স্মরণ করে বলেছেন, ইসরাইলের এক নারী সেনা কর্মকর্তা দুই সেনাসদস্যকে নির্দেশ দেন তাঁকে ওপরে তুলে ধরতে। এরপর মেঝেতে লাগানো একটি ধাতবখণ্ডের ওপর তাঁকে রেখে চাপ দিলে সেটি পায়ুপথে ঢুকে যায়। এতে রক্তপাত ও অসহনীয় যন্ত্রণা হয় তাঁর।
ফিলিস্তিন বিষয়ক জাতিসংঘের মূল সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর ফাঁস হওয়া এক প্রতিবেদনেও ফিলিস্তিনি বন্দী নির্যাতনের একই রকম বর্ণনা পাওয়া গেছে। এক বন্দী বলেছেন, ইসরাইলি সেনারা তাঁকে উত্তপ্ত ধাতব দণ্ডের মতো কোনো কিছুর ওপর বসান। তাঁর মনে হচ্ছিল, যেন আগুনের ওপর বসানো হয়েছে তাঁকে। আরেক বন্দীর পায়ুপথে ইলেকট্রিকের দণ্ড ঢোকানো হলে মারা যান তিনি। আবু গারিবেও একইভাবে মৃত্যু হয়েছিল অনেক বন্দির।
ইসরাইলের বন্দিশিবিরে অমানবিক অবস্থায় থাকার বর্ণনাও দিয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে, অন্তর্বাস ছাড়া সব পোশাক খুলে রাখা হয়েছে। এর আগে সামরিক ট্রাকে গাদাগাদি করে তুলে এসদে তেইমান শিবিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। পরে সেখানে তাঁদের বিশেষ ধরনের হ্যাঙ্গারে রাখা হয়।
হাতকড়া পরা অবস্থায় মাদুরে চুপ করে বসে থাকতে বাধ্য করা হয় দিনে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। শ্রান্ত-ক্লান্ত বন্দীরা ঘুমের ঘরে ঢলে পড়লে কর্মকর্তারা তাঁদের ডেকে নিতেন ও শাস্তিস্বরূপ পেটাতেন। এযেন এক গুয়ানতানামোর আরও এক আধুনিক রুপ।
কারণ আলাদাভাবে শুধু জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়াই ছিল এক দুঃস্বপ্নের অগ্নিপরীক্ষা। তদন্তে জানা গেছে, বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এক বিশেষ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো; যেটিকে তাঁরা বলতেন 'ডিসকো রুম। সেখানে তাঁরা যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন, সে জন্য অতি উচ্চশব্দে বাজানো হতো গান। এ ছিল নতুন ধরনের নির্যাতন! এমন এক ঘটনায় এক বন্দীর কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে।
একবার ভাবুন তো কতটা শব্দে একজন মানুষের কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে? কতাটা অসহ্য যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে। কারণ একজন মানুষের স্বাভাবিক বা সহনীয় শব্দের মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে মানুষ।
সাধারণত সর্বোচ্চ দেড়'শ ডেসিবেল শব্দে মানুষের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে পারে এবং ১৮০-২০০ ডেসিবেলে মৃত্যু ঘটাতে পারে। তার মানে এখানে ওই ফিলিস্তিনি বন্দিকে দেড়'শ ডেসিবেলে অতি উচ্চ শব্দে গান শুনিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। কান দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে রক্ত! কতটা বর্বর একজন নিরিহ মানুষের ওপর এমন বর্ববরতা চলতে পারে?
আবার ডায়াপার ছাড়া বন্দীদের পুরো বিবস্ত্র করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আবু গারিব আর গুয়ানতানামোই ঠিক একইভাবেই বিবস্ত্র করে নির্যাতনের চিত্রের অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর কেন এমন নির্যাতন চালিয়েছে? উত্তর একটাই, নিরীহ ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি হামাসের সাথে যুক্ত কিনা তার স্বীকারক্তি আদায় করতেই চলেছে এমন মারধর।
এসদে তেইমান বন্দিশিবিরে আটক ফিলিস্তিনিদের ‘পদ্ধতিগত উপায়ে নির্যাতনের’ এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাদের দাবি, বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হয়ে থাকে।
এর মধ্যে সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় ছিলো, অক্টোবরের পর ওই এক শিবিরেই প্রায় চার হাজার মানুষকে বন্দী করে রাখা ও তাঁদের মধ্যে ৩৫ জনের মারা যাওয়ার বিষয়টি। এই বন্দীরা হয় শিবিরের ভেতর, নয় কাছাকাছি বেসামরিক হাসপাতালে নেয়ার পর মারা গেছেন।
এসদে তেইমান বন্দিশিবিরের এসব ঘটনা গণমাধ্যমে ক্রমেই আরও বেশি আলোচিত হচ্ছে। গত মাসে খোত মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন ওই শিবিরে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, দুর্ব্যবহারের ভয়ানক চিত্র প্রকাশ করেছে।
সাবেক বন্দিরা নির্যাতনের যেসব বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে ছিল যথেষ্ট মিল। আর তা ছিল ইসরাইলি সেনাদের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে বন্দিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানোর অস্বস্তিকর ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নির্যাতনের শিকার এসব মানুষের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ওদের বেঁচে থেকেও অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জীবন কাটাতে হবে। অথবা ধুকে ধুকে মরতে হবে।
শুধু তাই নয় একবার ভাবুন তো, এই যুদ্ধে সরকারি হিসাবে প্রায় ৪০ হাজার মৃত্যু, বেসরিকারি হিসাবে যেটি আরও তিন গুন বেশি, এছাড়া, প্রায় দুই লাখ মানুষের আহত হওয়ার খবর। তার মানে কত কত মানুষের অনিশ্চিত জীবন। এসব আহতদের মধ্য কত কত মানুষে হাত নেই, পান নেই, চোখ নেই। অর্থাৎ এক এক জন আহত মানুষের এক একটা হৃদয়বিদারক গল্প তৈরি করেছে।
নির্যাতনের অভিযোগের পর, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এক আবেদনের ওপর শুনানি শুরু করেছেন ইসরাইলের সুপ্রিম কোর্ট। পরে সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের বন্দিশিবিরটি পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী পরিচালিত কারাগারগুলোয় স্থানান্তর করা শুরু করা হয়েছে।
এরপরও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসরাইল। তারা বলছে, কোনো বন্দিদেরই নাকি নির্যাতন করা হয়নি, এমন কিছু ঘটলে তারা তদন্ত করে দেখবে। তাতে কী আসে যায় বলনু, এই যে বিশ্বব্যাপি এত নিন্দার ঝড়, জাতিসংঘসহ নানা মানবাধিকার সংস্থা একের পর ইসরাইল বিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এত কিছুর পরও কী ওই বর্বরদের আটকানো গেছে? নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বিন্দুমাত্র পিছ পা হয়েছে? বিশ্ববাসীকে বুড়ো আঙ্গল দেখিয়ে সভ্য সমাজে তাদের তাদের সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ওদের থামাবে কে? আর যুদ্ধ থামলেও কী বন্দি থাকা মানুষের নির্যতান বন্ধ হবে? আছে কি সেই গ্যারান্টি?