শুক্রবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
22 Nov 2024 03:11 pm
খোকন হাওলাদার,সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি:- হলের মধ্যে স্বামীকে আটকে রেখে পাশের জঙ্গলে নিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণের পর চার দিন ধরে আন্দোলন চলছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির পাশাপাশি ক্যাম্পাসের অন্য সমস্যাগুলোও আলোচিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে বড় হয়ে সামনে এসেছে ‘ক্যাম্পাসে বহিরাগত অছাত্র’ ও ছাত্রত্ব শেষের পরও হলে থেকে যাওয়ার বিষয়টি। এ থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করার দাবি তুলেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে বহিরাগত নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের এক নেতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয় পরদিন সকালে। গতকাল বুধবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও দুজনকে। ধর্ষণের মূল পরিকল্পনাকারী মামুনুর রশিদ ওরফে মামুনকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে এবং তাঁকে সহায়তাকারী মো. মুরাদকে নওগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারী) রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক আল আমিন।
ধর্ষণের ঘটনার পরদিন রোববার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সঙ্গে সিন্ডিকেটের সভায় ৪টি সিদ্ধান্তও হয়। এগুলোর মধ্যে একটি ছিল পড়াশোনা শেষ করা ছাত্রদের হল ছাড়ার নির্দেশনা।
সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যাঁদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, সেসব শিক্ষার্থী এবং অবৈধভাবে হলে থাকা অন্যান্য শিক্ষার্থী ও পোষ্যদের ৫ কর্মদিবসের মধ্যে হল ছাড়তে হবে। না ছাড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে ক্যাম্পাসের চিত্র বলছে ভিন্নকথা। এর আগেও কয়েকবার এমন নির্দেশনা দেওয়া হলেও সমাধান আসেনি। কয়েক দিন হল প্রশাসন বিভিন্ন রুমে গিয়ে মৌখিকভাবে বলে আসে। এরপর আর কোনো প্রক্রিয়া এগোয় না।
হলের আবাসিক শিক্ষকেরা বলছেন, এমন আদেশ আগেও দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো সমাধান আসেনি।
জানা যায়, ক্যাম্পাসে মোট হল ১৯টি ছেলেদের ১০টি ও মেয়েদের ৯টি। হলে আসন-সংকটের লক্ষ্যে গত এক বছরে নতুন তিনটি হল খুলে দেওয়া হলেও কোনো সমাধান আসেনি; বরং ৬ মাস পর সশরীরে ক্লাস করতে আসা ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখনো হলের গণরুমে রয়েছেন। তাঁদের যাতে গণরুমে থাকা না লাগে, সে জন্য এর আগে তাঁরা অনলাইনে ক্লাস করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, ক্যাম্পাসে বৈধ ছাত্র রয়েছেন ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার। তাঁদের মধ্যে ২ হাজারের বেশি পড়াশোনা শেষ করা শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন হলে রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে হলে অবস্থান করেন। আর ৪০০ জনের মতো আছেন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, যাঁদের পড়াশোনা শেষ হয়েছে; কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয়ে হলে অবস্থান করেন।
জানা যায়, ক্যাম্পাসে এখন চলমান ব্যাচ ৪৭ থেকে ৫২ পর্যন্ত। তবে হলে অবস্থান করছেন ৪১ ব্যাচ থেকে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে গতবছর স্নাতকোত্তর শেষ হয়ে যাওয়া ৪৬ ব্যাচ ও তার আগের বছর শেষ হওয়া ৪৫ ব্যাচ। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিচয়ে হলে বেশি সংখ্যা রয়েছে ৪৪ ব্যচের।
আ ফ ম কামালউদ্দীন হলের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই হলে মোট কক্ষের সংখ্যা ২০৬। এগুলোর মধ্যে ছাত্র থাকতে পারবেন এমন আসন ৪১২টি। এর মধ্যে প্রায় ২৫টি কক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের দখলে রয়েছে। বাকি ১৮১টি কক্ষের মধ্যে ৯০টিতে পড়াশোনা শেষ করা বা অন্য হলের শিক্ষার্থী আছেন। এই সংখ্যা ১৮০ জন। তবে শিক্ষকদের কাছে রাজনৈতিক কক্ষগুলোতে কতজন শিক্ষার্থী আছেন, তার সঠিক হিসাব নেই।
এই হলের একজন আবাসিক শিক্ষক বলেন, এসব ছাত্রকে হল থেকে বের করা তাঁদের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় থাকা কক্ষগুলো থেকে তাদের স্টাফ কোনো তথ্য পাননি। আবার অনেকে আছেন যাদেরকে বের হতে বললে তারা অন্য ব্যাচের রেফাসেন্স দিয়ে বের হতে চাননা।
তিনি বলেন, তাদের কাছে এমন কোনো নির্দেশনা নেই যে কেউ বের না হলে তাঁর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা ৫ দিনের আল্টিমেটাম শেষ হলে হয়ত বোঝা যাবে।
এই শিক্ষকের বক্তব্যের সঙ্গে মিল রয়েছে ক্যাম্পাসের অন্য হলের চিত্রতেও। প্রতিটি হলে প্রায় ২০০ এর বেশি এমন শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। তবে রাজনৈতিক পরিচয়ে থাকার চেয়ে বেশি আছেন স্নাতকোত্তর শেষ হয়ে চাকরির পরীক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি আবাসিক হলের শিক্ষক বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে যারা থাকেন তাদেরকে বের করা প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। অনেক হলে এই বিষয়ে কোনো কথাও বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে হল প্রশাসনকে বিভিন্ন সময়ে আদেশ ও নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে অনেকক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নের কোনো রুপরেখা থাকে না। এর কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের আধিপত্য ও প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক এই প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়।
এই শিক্ষক বলেন, তার হলে কোনো রাজনৈতিক কক্ষে শিক্ষকেরা যাচ্ছেন না। তারা শুধু অরাজনৈতিক ছাত্রদেরকে বের হতে বলছেন। এতে করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক নেতাদের বিষয়ে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না সেটি নিয়ে তর্কে জড়িয়ে যাচ্ছেন।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নিগার সুলতানা বলেন, তাঁদের কাছে কে রাজনৈতিক আর কে অরাজনৈতিক, সেটা মুখ্য নয়। ছাত্র হিসেবে তাঁরা বিষয়গুলো দেখছেন। তাঁর যদি পড়াশোনা শেষ হয়, তাহলে তাঁকে চলে যেতে হবে।
অছাত্রমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি জানিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ধর্ষণের প্রতিবাদ এবং জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করে শিক্ষক সমিতি। মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শাহেদ রানা।
মানববন্ধনে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদে অছাত্ররা হলে বসবাস করছেন। তাঁদের বিতাড়ন করা ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ-জেইউ) অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
চতুর্থ দিনের মতো নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত ছিল ক্যাম্পাসে। গতকাল সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পক্ষ নিপীড়নবিরোধী কর্মসূচি শুরু করে।
এদিন নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের চার দফা দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভা ঘেরাও কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ডিকেট স্থগিত করেন উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রশাসনিক কিছু কাজ রয়েছে। এগুলো সম্পন্ন করার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। কাজগুলো হলে পুনরায় সিন্ডিকেট সভার তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
বেলা ১১টায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটররা মানববন্ধন করেন। একই স্থানে দুপুর ১২টায় শিক্ষক সমিতি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
বেলা তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলকে কার্যকরসহ পৃথক চারটি দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে।
আর বিকেল ৫টায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মিছিল করে।