রবিবার, ০৭ জানুয়ারী, ২০২৪
01 Feb 2025 01:58 am
৭১ভিশন ডেস্ক:- রাত পোহালেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনের জন্য প্রস্তত গোটা দেশ। অথচ নির্বাচনকে ভণ্ডুল করতে এমন কোনো ষড়যন্ত্র নেই, যেটা করেনি বিএনপি। চলন্ত ট্রেন, গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ করে নিরীহ মানুষকে হত্যা এবং হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে সহিংসতা চালিয়ে ভোট দিতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছে তারা।
এবার সেই দলটির ভাষায় ও তাদের প্রচারিত অসত্য তথ্য দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস ও এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসহ কয়েকটি গণমাধ্যম উদ্দেশ্যমূলক ও বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রতিবেদন একপেশে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তারা। প্রতিবেদনটিতে দেখা গেছে, কারাবন্দিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সত্যাসত্য নিশ্চিত না করেই বিএনপির মিডিয়া সেলের দেয়া পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। যা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিপন্থী।
এরআগে রাজনৈতিক সংগঠনের মতো তৎপর হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের বিরুদ্ধে। নিজেদের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পোস্ট করে সমালোচনারও জন্ম দিয়েছিল তারা। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, এসব তৎপরতা ব্যর্থ হওয়ার পর নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
‘এ ওয়ান-সাইডেড অ্যাফেয়ার অ্যাজ বাংলাদেশে’জ এইলিং ডেমোক্র্যাসি গোজ টু দ্য পোলস’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি লিখেছেন মুজিব মাশাল ও সাইফ হাসনাত। মুজিব মাশাল নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশীয় ব্যুরোপ্রধান।
একপেশে তথ্যে শেষ ছোবলের চেষ্টা
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘তারা যেখান থেকে, যাদের মাধ্যমে চালিত হন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে এতে। এই প্রতিবেদন নিজের আঙ্গিক থেকে করেছেন প্রতিবেদকরা। তারা যেটা মনে করেছে, যেটা চাইছে—প্রতিবেদনে সেটিরই প্রতিফলন ঘটেছে।’
উদহারণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক যখন কিছু চায়, তখন ধরে নিতে হবে, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব শক্তি এর সঙ্গে জড়িত। এখানের বিষয়টিও তেমনই। বাংলাদেশের ভোট নিয়ে পশ্চিমারা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিলেন। তারপরেও তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেষ ছোবল দেয়ার চেষ্টা করেছেন তারা।’
এতে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি বলেও মনে করেন এই সাংবাদিক নেতা।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে প্রতিবেদনের কোনো মিল নেই। এটিকে একপেশে বলে মনে করে বাংলাদেশের জনগণ।
প্রতিবেদনে যা আছে
প্রতিবেদনটির সূচনায় বলা হয়েছে, ‘রোববারের (৭ জানুয়ারি) নির্বাচনে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এ নিয়ে সামান্যই সন্দেহ আছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র কী অবশিষ্ট থাকবে।’
এরপর বলা হয়েছে, বিরোধী দল বিএনপি চূর্ণ-বিচূর্ণ। তাদের সক্রিয়তার সক্ষমতা সামান্যই বাকি আছে। দলটির নেতাদের মধ্যে যারা কারাগারের বাইরে আছেন, তারা পলাতক কিংবা বিভিন্ন মামলায় হাজিরার জালে আটকে আছেন। তাদের দাবি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগে অস্বীকার করায় ভোট বর্জন করেছে দলটি। হরতাল ও অসহযোগের ডাক দিয়ে বিরোধী দল যখন নির্বাচনের প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন সহিংসতার শঙ্কাও রয়েছে।
ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ করে বিএনপি নেতাদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গেল ২৮ অক্টোবরের পর ২০ হাজারের বেশি বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, কারাগারগুলোতে অতিরিক্ত বন্দি থাকায় সেখানকার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। এখন পর্যন্ত ৯ বিরোধী নেতাকর্মী কারাগারে মারা গেছেন।’
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। যেটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে উল্লেখ করেছেন ইউনূস। তিনি বর্তমানে জামিনে আছেন এবং রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করছেন।
ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেয়ার চাপ
কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিচারের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। আদালত থেকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য তারা চাপ দিচ্ছিলেন। দুনিয়াতে এমন দৃশ্য আর কোথাও নেই। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ নিজের সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।’
বিচারের পরে ড. ইউনূস মার্সি (অনুকম্পা) চাইতে পারেন বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, মামলা তুলে ফেলতে হবে, এটা ফ্রাংকেস্টাইনের মতো চাপ। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরতান্ত্রিক।’
গেল ১ জানুয়ারি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে না দেয়ার অপরাধে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তার (ইউনূস) প্রতিষ্ঠান ঘুষ দিয়ে সেটি ‘ম্যানেজ’ করার অপচেষ্টাও করেছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন শ্রমিকেরা আদালতে গেছেন, তখন আদালতের বাইরে দু'জন শ্রমিকনেতাকে তার প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ কোটি করে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকেরা তো আর টাকা পাননি, দু'জন নেতা টাকা পেলে তো আর হবে না। সে কারণে সাধারণ শ্রমিকেরা মামলায় গেছেন।’
শিকড় উপড়ে গাছ চাইছে বিএনপি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। এতে দলটি ব্যাপক সহিংসতারও আশ্রয় নিয়েছে। সিনিয়র সাংবাদিক কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘এটা সত্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অংশ এই ভোটে অংশগ্রহণ থেকে বিরত আছে। তাদের দাবি, একেবারে শিকড় উপড়ে ফেলে তাদেরকে গাছটা দিতে হবে। সেটা তো আর হয় না। রাজনীতি হচ্ছে কৌশলের খেলা। যদি তাদের জনসমর্থন থাকত, তাহলে শেকড় উপড়ে ফেলে দেয়ার কথা তারা বলতেন না। তাদের জনসমর্থনের অভাব রয়েছে, যে কারণে তারা বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন।’
সিনিয়র এই সাংবাদিকের মতে, ‘বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশে সাড়ে ১৭ কোটি জনগণ। কাজেই এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতই মাঠে থাকুক, সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার যদি কোনো আশ্রয় থাকে, তাহলে তারা সহিংসতা করবেই। তাদের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। যে কারণে ফাঁকফোকর দিয়ে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে না থাকতো, তাহলে আরও ভয়াবহ অবস্থা হতে পারতো।’
তিনি জানান, ‘একজন দুষ্কৃতকারী যে কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে, কিন্তু একশ' মানুষ একটা ভালো কাজ করতে সময়ে নেয়। যে কোনো মুহূর্তে একটা মানুষ একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। তবে আশা করছি, আগামীকালের ভোট শান্তিপূর্ণভাবে হবে। নির্বাচনে ছোটোখাটো বাধা থাকবে, তবে সেটা উতরে নিতে হবে। জনগণের সমর্থন থাকবে।’
বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের অগ্রগতি অনেকের কাছেই চোখে পড়ার মতো জানিয়ে এই সাংবাদিক নেতা বলেন, বাংলাদেশের ভোট নিয়ে তো কারও ভাবার কথা না। কিন্তু বাংলাদেশের যেভাবে দ্রুতই উত্থান হচ্ছে, তা অনেক দেশই মানতে পারছে না। আন্তর্জাতিক দুই মেরুকরণের মধ্যে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ নীতিও অনেকে মেনে নিতে পারছেন না।
ভুল তথ্য দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতেই ভুল তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছে নিউইয়র্ক টাইমস। বিএনপির মিডিয়া সেলের দেয়া বানোয়াট ও ভিত্তিহীন তথ্য কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই না করে এভাবে প্রকাশ করা বস্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিপন্থী।
বাংলাদেশে মোট কারাগারের সংখ্যা ৬৮টি। কারা অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত প্রতিটি কারাগারে বন্দির সংখ্যা ৮০ হাজার ৯৭ জন। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের বন্দির সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার ৮৭১ জন, ২০২২ সালের একই দিন বন্দি ছিল ৮০ হাজার ৫৩৭ জন এবং ২০২৩ সালের শেষ দিন ছিল ৮৩ হাজার ৬৮৯ জন।
কারা সূত্র জানায়, আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৩ সালের শেষ দিনে বন্দির সংখ্যা প্রায় একই ছিল। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় বিএনপির ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছে বলে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তা সঠিক না। এটি একটি অপপ্রচার।
এছাড়াও ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ স্টেশনে গড়ে প্রতিদিন ৫৬৫টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং এক হাজার ৯৫৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন। কোনো প্রকার রাজনৈতিক উত্তেজনা বা সংঘাত না থাকলেও বাংলাদেশের প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে মামলা দায়ের এবং গ্রেফতারের গড় সংখ্যা এ অবস্থায় থাকে।
কিন্তু ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি জোরদার হওয়ার পর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ৪৩৮টি মামলা এন্ট্রি হয়েছে এবং ১ হাজার ৮১৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন। ২৮ অক্টোবর পরে বিএনপি- জামায়াতের নজীরবিহীন সন্ত্রাসের পরে গ্রেফতারের সংখ্যা বাড়লেও অন্যান্য অপরাধের মামলার সংখ্যা কমেছে।
কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গেল ২৬ অক্টোবর থেকে থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিস্ফোরক দ্রব্য, নাশকতা, হত্যা, সাংবাদিকের উপর আক্রমণ, গাড়ি ভাঙচুর সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে পুলিশ মোট ২০ হাজার ৪৬ জন গ্রেফতার করে একইভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ১০ হাজার ৯৯৭ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। ৬ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত মামলায় মোট ৯ হাজার ৪৯ জন বন্দি কারাগারে রয়েছে।
এছাড়াও ২০২৩ সালের অক্টোবরে সারাদেশের কারাগারে মোট ৪৪ জন বন্দির শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, যা নভেম্বর মাসেও একই সংখ্যক ছিল। ডিসেম্বরে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতা অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা ব্যতীত জেলের অভ্যন্তরে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।
জেলের অভ্যন্তরে কোনো বন্দিকে কখনো নির্যাতনও করা হয়নি। কারণ বন্দিদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিউইয়র্ক টাইমসের দেয়া ৯ জন বিএনপি নেতাকর্মীর মৃত্যুর কোনো নাম ঠিকানাও দেয়া হয়নি। তাদের প্রচারিত তথ্য ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এদিকে, নির্বাচন ঘিরে একপাক্ষিক সংবাদ প্রকাশের প্রতিবাদ জানিয়েছে ১৯৭৭ কথিত সামরিক বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের কান্না। সংগঠনটি বলছে, এসব গণমাধ্যম নির্বাচন উপলক্ষে বাংলাদেশে এসে একপাক্ষিক সাংবাদিকতা করছে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানান তারা।
নিউজ সময়