সোমবার, ০৭ আগস্ট, ২০২৩
27 Nov 2024 12:44 pm
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গত কয়েক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে পূর্ববর্তী ৯ মে আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর দেশজুড়ে যে বিক্ষোভ প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল, ৫ আগস্টের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই।
ইমরান খানকে গ্রেফতার পরবর্তী তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ভাগ্যে কি ঘটতে পারে তা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে।
ইমরান খানকে গত মে মাসে প্রথমবার গ্রেফতারের পর পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত লোকজন রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে, একের পর এক ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় সেনাবাহিনী পর্যন্ত নামানো হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকে গ্রেফতারের পর শনিবার রাতটি পাকিস্তানের অন্যান্য যেকোনও সাধারণ রাত থেকে আলাদা ছিল না।
রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রি করে পাওয়া অর্থের বিষয়ে ঘোষণা না দেওয়ার দায়ে তিন বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ইমরান খান বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এই সাজার ফলে আগামী নির্বাচনে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে।
গ্রেফতারের আগে রেকর্ডকৃত এক ভিডিও বার্তায় লোকজনকে ঘরে বসে না থেকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আপাতত তাতে কোনও কাজ হয়নি। কিন্তু কেন এমনটা ঘটলো?
সরকারের মন্ত্রীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা বলবেন, এর কারণ হল লোকজন ইমরান খান বা তার দল পিটিআইকে আর অনুসরণ করতে চায় না। তারা আগের সহিংসতার জন্য দায়ী একটি গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হতে চায় না। তবে এটি ইমরান খানের সমর্থকদের বার্তা নয়।
রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে ইমরান খানের সম্পর্ক এক বছরেরও বেশি সময় আগে তিক্ত হতে শুরু করে। দেশটির সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনতির খেসারতও তাকে দিতে হয়েছে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে।
এরপর থেকে ইমরান খান আগামী নির্বাচন পর্যন্ত চুপচাপ অপেক্ষা না করে ধারাবাহিকভাবে সামরিক নেতৃত্বের সমালোচনা করছেন। মে মাসে ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর দেশটিতে সামরিক স্থাপনায় হামলা করেছিল পিটিআইয়ে কর্মী-সমর্থকরা। ওই সময় দেশটির সামরিক বাহিনী সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নেবে বলে জানায়।
পরবর্তীতে দেশটিতে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান ইমরান খানের দলকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। তার হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার নিন্দা সত্ত্বেও সহিংসতায় জড়িত বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
পাকিস্তানের কিছু গণমাধ্যম বলছে, মে মাসের শেষের দিকে সামরিক বাহিনীর সাথে টিভি স্টেশনের মালিকদের বৈঠকের পর থেকে সাংবাদিকদের আর ইমরান খানের নাম বলতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি টিভিতে তার ছবি অথবা টিকারে তার নাম লিখতেও দেওয়া হয় না।
দেশটিতে আগে অনেক সোচ্চার ছিলেন এমন সমর্থকরাও বলেছেন, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পিটিআই বা দলটির নেতার সম্পর্কে পোস্ট করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের পোস্টগুলোও মুছে ফেলেছেন। এমনকি জনসমক্ষে দেওয়া ভাষণও তারা আর আর দেখছেন না। কারণ ইমরান খানের ভাষণ তারা দেখছেন, সেটি আবার অন্য কেউ নজরদারি করছেন কি না তা নিয়ে ভীত তারা।
দেশটির সরকার বলছে, তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করছে না। বিবিসির উর্দু বিভাগের সাংবাদিকরা শনিবার বিকেলে লাহোরে ইমরান খানের বাড়ির বাইরে পিটিআই সমর্থকদের জড়ো হতে দেখেছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের তুলে নিয়ে গেছে। এছাড়া তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে কি না সেটিও স্পষ্ট নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের সাথে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, তারা প্রায় ১০০ পিটিআই সমর্থককে গ্রেফতার করেছে। তিনি বলেছেন, পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ইমরান খানের সমর্থকরা যাতে জমায়েত হতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, আমি মনে করি, কঠোর দমন-পীড়ন অভিযান ইমরান খানের সমর্থকদের বশ্যতা স্বীকারে ভীত করে তুলেছে।
‘আমি প্রকৃত অর্থে মনে করি, আমরা গত ৯ মে যেভাবে দেখেছি, পিটিআইয়ের সমর্থকরা বর্তমানে সেভাবে নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলতে আগ্রহী নন। এক দিক থেকে সামরিক বাহিনী সঠিকভাবেই খেলেছে। ইমরান খানের সমর্থকরা বৃহত্তর ও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল, সেই জায়গায় সামরিক বাহিনী এসব নৃশংস কৌশল ব্যবহার করেছে।’
ইমরান খানের আইনি দল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে চায়।
গত কয়েক মাস ধরে ইমরান খানের আইনজীবীরা বারবার তার জন্য বিভিন্ন আদালত থেকে অস্থায়ী জামিনের ব্যবস্থা করেছেন। অন্যান্য আদালতে দায়ের করা গুরুতর কিছু মামলা বন্ধ করার পরিবর্তে বিলম্বিত করছেন।
এসব মামলা অব্যাহত থাকবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। ইমরান খান গত মে মাসে তার গ্রেফতারের ঘটনাকে একেবারে ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশে নাটকীয়ভাবে উল্টে যেতে দেখেছেন।
গত কয়েক দশকে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, বেনজির ভুট্টো এবং সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের মতো আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ইমরান খান। পিটিআইয়ের এই নেতা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কয়েকজনকে কারাগারে বন্দী করেছিলেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা প্রায়ই বলেন, দেশের বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যদিও তাদের বিরোধীদের ক্ষেত্রে আবার এই বিচারবিভাগের রায়কে সঠিক বলে মনে করেন তারা।
ইমরান খান যদি সরকারি দায়িত্বে অযোগ্য বিবেচিত হন, তাহলে তার দলের কী হবে তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে, তিনি বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হোন বা না হোন পিটিআই টিকে থাকবে এবং এগিয়ে যাবে। এখন তার ভবিষ্যদ্বাণীর নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘নির্বাচনের বিষয়ে পরবর্তী বড় প্রশ্ন হল, পিটিআইয়ের বাকি নেতৃত্ব কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবে? তারা কি সমর্থকদের রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করবে, সেটা কি সফল হবে? আর এটি একটি ভালো পরীক্ষা হবে।’
পিটিআই মূলত ইমরান খানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক দল। এমনকি ভোটের ফরমেও মুদ্রিত এর লোগোটি ক্রিকেট ব্যাটের প্রতীক; যা একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসাবে ইমরান খানের পূর্ববর্তী ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ইমরান খানকে ঘিরে থাকা অনেক জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক তার দল ত্যাগ করেছেন। তার দলের সঙ্গে জড়িত অন্য নেতারা গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছেন। দলের পক্ষে কার্যকর রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো সহজ হবে, এসবে তার কোনও ইঙ্গিত মিলছে না।
সূত্র: বিবিসি