বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩
22 Nov 2024 11:16 am
সাজু মিয়া শিবগঞ্জ (বগুড়া) প্রতিনিধিঃ ভারতীয় উপমহাদেশে মসলার আদি ব্যবহার মূলত রং ও ওষুধ হিসেবে ছিল। ঔষধি গুণের কারণেই এটি পরে খাবারের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে ওঠে। ২ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ উপমহাদেশে মসলা দারুচিনি, কালো মরিচ ও ভেষজ দিয়ে বিকশিত হয়েছিল। সুগন্ধ ও উদ্বায়ী তৈল থাকার জন্যই মসলার কদর। খাদ্যের স্বাদ বাড়াতে সহায়তা করলেও মসলা কোন প্রধান খাদ্য নয়। সাধারনত: গ্রীষ্মমন্ডলীয় কিছু উদ্ভিদ থেকেই প্রধানত মসলা সংগৃহীত হয়।
স্পাইস শব্দটি প্রাচীন ফরাসি শব্দ থেকে এসেছে। যার বাংলা নাম হচ্ছে মসলা। বিশ্বে প্রায় ১১৩টি মসলা ফসলের চাষ হলেও বাংলাদেশে ৩০ ধরনের মসলা ফসল চাষ করা হয়। আমাদের দেশের খাবার তালিকায় প্রায় ৩৫ রকমের মসলার ব্যবহার করা হয়। দেশের সকল অ লে মসলার আবাদ কাঙ্খিত মানের না হওয়ার বিদেশ থেকে প্রতিবছর মসলা আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানো হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বগুড়া থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে মহাস্থানগড়ের অদূরে শিবগঞ্জ উপজেলায় ৭০ একর জমির ওপর এই মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয় ১৯৯৬ সালে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধিনে এ গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত হয়। কেন্দ্রটি মসলার বহুমুখী জাত উদ্ভাবন করে সকলের নজরে এসেছে। এ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের অধীনে ৩টি আ লিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র ও ৪টি উপ-আ লিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। আ লিক মসলা কেন্দ্র মাগুরা, কুমিল্লা ও গাজীপুরে। উপ-আ লিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র লালমনিরহাট, ফরিদপুর, সিলেট ও খাগড়াছড়িতে।
মসলা গবেষকগণ বলেছেন, শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবনী মসলা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দিতে পারলে মসলা আমদানিতে বহু কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে না। মসলা চাষ ও গবেষণায় দেশ অনেক এগিয়ে গিয়েছে। দেশে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে মসলা ফসল চাষে উৎপাদিত হচ্ছে অন্তত ৪৪.৯৬ লক্ষ মেট্রিক টন মসলা। যা মোট চাহিদার ৫৮.৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। এছাড়াও ৪৪.৯৬ লক্ষ মেট্রিক টন মসলা আমদানি করতে হয়। তারপরেও দেশে মসলার ঘাটতি রয়েছে ১৩.৫৪ লক্ষ মেট্রিক টন । তাদের ভাষ্য মতে, ২০১৯-২০২০ সালে মসলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। বিবিএস এর তথ্য মতে, মাথাপিছু মসলা গ্রহণের পরিমান ৭২ গ্রাম। কিন্তু ঘাটতির কারণে তা গ্রহণ করতে পারছেনা ভোক্তাশ্রেণী।
শিবগঞ্জ মসলা গবেষনা কেন্দ্রের তথ্য মতে, এ গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত উচ্চ ফলনশীল (উফশী) নানা জাতের মসলা উদ্ভাবন করেছে। এ পর্যন্ত ৪৬ টি মসলা ফসল নিয়ে গবেষণা করে ১৫৬টি মসলা ফসলের প্রযুক্তি ও ৫১টি জাত উদ্ভাবন করেছে এ গবেষণা কেন্দ্র। এর মধ্যে পেঁয়াজের ৭টি, পাতা পেঁয়াজের ১টি, মরিচের ৪টি, অর্নামেন্টাল মরিচের ২টি, রসুনের ৪টি, আদার ৩টি, হলুদের ৫টি, ধনিয়ার ২টি, বিলাতি ধনিয়ার ১টি, কালোজিরার ১টি, মেথীর ৩টি, ফিরিঙ্গী ১টি, মৌরির ২টি, শলুক ১টি, রাধুনী ১টি, জাউন ১টি, একাঙ্গীর ১টি, চিভের ১টি, পুদিনার ২টি, আলুবোখারার ১টি, দারুচিনি ১টি, তেজপাতা ১টি, গোলমরিচের ১টি, পানের ৩টি, এবং জিরার ১টি জাত। যা বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে ব্যপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে।
মসলা ফসলের উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হলো, ঢিবি পদ্ধতিতে আদা রোপণের উন্নত প্রযুক্তি,জিংক ও বোরন প্রয়োগে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ ধারণ, ফলন এবং গুণগত মান বৃদ্ধি, বিনা চাষে মালচ ব্যবহার করে মান সম্পন্ন রসুন উৎপাদন, চুন এবং বোরন প্রয়োগে রসুনের ফলন এবং সংরক্ষণ যোগ্যতা বৃদ্ধি, চারার মাধ্যমে হলুদ উৎপাদন, হলুদের লিফ বেøাচ রোগ দমন, হলুদের ছত্রাকজনিত কন্দ পঁচা রোগ নিয়ন্ত্রণ, হলুদের সাথে সারা বছর সব্জি জাতীয় ফসলের চাষ, হলুদ ও মরিচের আন্তঃফসল চাষ, হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে পেঁয়াজের (গাছে আগাম পূষ্পদন্ড বের হওয়া) দূরীকরণ, সঠিক মাত্রায় নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম প্রয়োগ করে আদার ফলন বৃদ্ধি, সঠিক বীজ হার ও বপন পদ্ধতিতে কালোজিরা উৎপাদন, সঠিক পরিমাণে নাইট্রোজেন ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে পেঁয়াজ কর্তন করে কন্দ উৎপাদন এবং গুণগত মান বৃদ্ধি, সঠিক রোপন দূরত্ব ও বীজের আকারের মাধ্যমে আদার উৎপাদন বৃদ্ধি, সঠিক দুরত্বে চারা রোপণ ও সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করে মরিচের ফলন বৃদ্ধি,সালফার ও জিংক প্রয়োগে হলুদের ফলন বৃদ্ধি, সালফার প্রয়োগের মাধ্যমে পেঁয়াজের ফলন বৃদ্ধি।
গ্রীষ্মকালীন পিয়াজের বীজ উৎপাদন কলাকৌশল, গ্রীষ্মকালীন মরিচ ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আন্তফসল চাষ, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আদার কন্দ পঁচা রোগ নিয়ন্ত্রণ, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আদার কন্দ পঁচা রোগ দমন, সমন্বিত পুষ্টি ও সেচ ব্যবস্থাপনায় রসুনের ফলন বৃদ্ধি, শীতকালীন পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনে চারা রোপনের সঠিক সময় ও রোপন দূরত্ব, শলুক ফসলের সারের মাত্রা, কন্দ উৎপাদনে পিঁয়াজের র্পাপল বøচ ও স্টেমফাইলিয়াম বøাইট রোগ দমন, রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন পিঁয়াজের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ, রসুনের বৃদ্ধি ও অধিক ফলনের জন্য পাতায় জিংক, ম্যাঙ্গানিজ এবং বোরন প্রয়োগ, মুখী কচুর সাথে শীতকালীন পেঁয়াজের আন্তঃফসল চাষ, মরিচের চুষি পোকা ও মাকড়ের সমন্বিত দমন পদ্ধতি, মরিচের ফলছিদ্রকারী পোকার সমন্বিত দমন পদ্ধতি, মালচিং এবং সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মান সম্পন্ন রসুন উৎপাদন, বীজ হিসাবে প্রাইমারী রাইজম ব্যাবহার করে হলুদ উৎপাদন, বীজ শোধন ও মাটিতে চুন প্রয়োগের মাধ্যমে আদার কন্দ পঁচা রোগ নিয়ন্ত্রন, পলিনেটর পোকা আকর্ষণকারী ফসল লাগিয়ে অধিক পিঁয়াজ বীজ উৎপাদন, পান উৎপাদনে নাইট্্েরাজেন, ফসফরাস ও পটাশের মাত্রা, প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঁচা মরিচের পাউডার তৈরী, প্রাইমিং ও হরমোন প্রয়োগে বিলাতি ধনিয়া বীজের অংকুরোদ্গম হার বৃদ্ধি করা, গৌণ পুষ্টি উপাদানের মাধ্যমে মরিচের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঠিক সময়ে রোপণ করে পেঁয়াজের বীজের ফলন ও সজীবতা বৃদ্ধি, অভি¯্রবনকৃত কাঁচা মরিচ, ধনিয়ার কান্ড ফোলা রোগের সমন্বিত দমন, ধনিয়ার বীজ বপনের সঠিক সময়, আলুবোখারার অংগজ বংশ বিস্তারে গুটি কলমের সময় ও হরমোন মাত্রা, আদার সাথে সারা বছর সব্জি জাতীয় ফসলের চাষ, আদার পাউডার তৈরী, আদা উৎপাদনের সঠিক সময়, আদা উৎপাদনের পদ্ধতি ও বীজের আকার, অলস্পাইস পাতার পাউডার তৈরী, পেঁয়াজের চুষি পোকার সমন্বিত দমন পদ্ধতি, গোলমরিচের দ্রæত বংশ বিস্তার, সেচের মাধ্যমে পেয়াজের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, মৌরী বপনের সঠিক সময় ও বপন দূরত্ব, মৌরী উৎপাদনে সেচ ও নাইট্রোজেন সারের মাত্রা, পেঁয়াজ কন্দের ফলন বৃদ্ধিতে সঠিক সেচ পদ্ধতি, পেঁয়াজের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে গাজর চাষ করে চুষি পোকা দমন, পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে কন্দ রোপনের সঠিক সময় ও রোপণ দূরত্ব, পেঁয়াজের বীজ ফসলে পার্পল বøচ রোগ দমন পদ্ধতি, তেজপাতার পাতা পোড়া রোগ দমন, সেচ ও মালচ প্রয়োগের মাধ্যমে আদার ফলন বৃদ্ধি, মেথী ফসলের সারের মাত্রা, পেঁয়াজ কন্দে ঠান্ডা প্রয়োগ এবং হিমাগার থেকে পেঁয়াজের বীজ কন্দ বের করার সময়, জৈব মালচিং এর মাধ্যমে হলুদের উৎপাদন বৃদ্ধি, কালোজিরার বীজের হার ও বীজ বপনের পদ্ধতি, মরিচের মানসম্পন্ন বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি, মেথীর মুল ও গোড়া পঁচা রোগ দমন, পিঁয়াজের কন্দ পঁচা রোগ দমন, মৌরির অলটারনারিয়া পাতা ও আম্বেল ঝলসানো রোগ দমন, মৌরির মুল ও গোড়া পঁচা রোগ দমন, আদার কন্দ পঁচা রোগের সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা, স্টোরে পিঁয়াজের রোগজীবানু ও বিভিন্ন জাতের পিয়াজের কন্দের পঁচন ও গজানোর হার নির্ণয়, শলুকের অলটারনারিয়া পাতা ও আম্বেল ঝলসানো রোগ দমন, মরিচের চোয়ানিফোরা রোগ দমন, মেথীর পাতার দাগ বা মরিচা রোগ দমন, বস্তায় আদা চাষ, ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে মাটি ছাড়া আদা চাষ, ধনিয়ার কান্ডের ফোলা (ধনিয়ার কান্ডের গল) রোগ দমন, হলুদের লিফ বেøাচ রোগ দমন, তেজপাতার পাতা পোড়া রোগ দমন এবং জিরার আগা পড়া দমন পদ্ধতি।
চলতি মসলার সঙ্গে গবেষণাধীন অন্যান্য অপ্রচলিত মসলা ফসলগুলো হলো: শলুক, তেজপাতা, রাঁধুনী, জোয়ান, ফিরিঙ্গি, চুঁইঝাল, একাঙ্গি, পিপুল, শঠি, দই রং, বচ, পুদিনা, পোলাও পাতা, লেমনগ্রাস, আম আদা, মিঠা তুলশি, পান, সুপারি, জিরা, কাবাবচিনি, চিভস, অলস্পাইস, কারিপাতা, পান বিলাস, লবঙ্গ, পেস্তা বাদাম, জয়ফল, জৈয়ত্রী, ভ্যানিলা, রোজমেরী, বিলাতি ধনিয়া ইত্যাদি।
শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার ড. মো: মাসুদ আলম বলেন, এ গবেষণা কেন্দ্রের অধিনে উদ্ভাবিত আদা-রসুনের গুড়া, পিয়াজের গুড়া, কাঁচা মরিচের গুড়া ইত্যাদি বানিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে মসলার ঘাটতি কিছুটা কমে যাবে ও দেশের আমদানী নির্ভরতা হ্রাস পাবে। উদ্ভাবিত সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তিগুলি মসলা গবেষণার কেন্দ্রের বড় ধরণের সাফল্য।
শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী ড. কে, এম, খালেকুজ্জামান জানান, “দেশের একেক এলাকার মাটি একেক ধরনের মসলা উৎপাদনের জন্য উপযোগী, শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্র যে যে মসলা উদ্ভাবন করছে তা মাঠ পর্যায়ের কৃষকের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে, এ মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে জিরা, ইসবগুল ও উচ্চ মূল্যের ভ্যানিলাসহ মসলা ফসলের আরো নতুন জাত উদ্ভাবনের উপর গবেষণা কাজ চলছে, এছাড়াও গ্রীষ্মকালীন পিয়াজকে কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানো এবং রাইজম পচাঁ প্রতিরোধী আদার জাত উদ্ভাবনে এ কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে”।
শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ জুলফিকার হায়দার প্রধান বলেন, মসলা প্রযুক্তি হস্তান্থরসহ গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন অ লের প্রায় ৫ হাজার ৬ শ’ জন বিজ্ঞানী, কৃষি কর্মকর্তা, বিএডিসি কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ গবেষণা কেন্দ্রে বিশাল পরিসরে গবেষণা কাজ পরিচালনার জন্য কর্মরত বিজ্ঞানীর সংখ্যা অপ্রতুল। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ফেলোশিপ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সিরিয়াল ফুড ও ভেজিটেবল চাষের আধিক্যের কারণে মসলা চাষের জমির স্বল্পতা রয়েছে। এ কেন্দ্রে বিদেশি মসলা জার্মাপ্লাজম সংগ্রহের সুযোগও কম। আবহাওয়াগত সমস্যা ও প্রশিক্ষিত জনবলের এখনো অভাব রয়েছে। এছাড়াও কীটপতঙ্গ, রোগ, খরা ও লবনাক্ত জেনোটাইপের অভাব রয়েছে। এ কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত সকল জাত ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে কাজ করে থাকে। মসলার ঘাটতি কাঙ্খিতভাবে কমিয়ে আনতে এ কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে।