বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪
01 Nov 2024 03:47 am
৭১ভিশন ডেস্ক:- রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বানেও অবস্থান বদলাবে না বিএনপি।এই ইস্যুতে সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার দলীয় যে অবস্থান আছে, তাতেই অনড় রয়েছে দলটি।
গত সোমবার রাতে দলের গুলশান কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দীর্ঘ বৈঠকে দলের নেতারা পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি অপসারিত হলে সাংবিধানিক শূন্যতা বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে বৈঠকে দলের নীতিনির্ধারকরা একমত হয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এই মুহূর্তে নির্বাচনের রোডম্যাপ জরুরি। কিন্তু তা না করে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু সামনে আসায় সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যবস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা মূল এজেন্ডা হওয়া উচিত।
কিন্তু হঠাৎ কেন রাষ্ট্রপতি ইস্যু সামনে এলো?’
বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেন, বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সাংবিধানিক পথেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং সেই সংবিধান উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক হবে না। দলটি মনে করছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংবিধান বাতিল ঘোষণা করা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট বা রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে।
দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার পেছনে দুরভিসন্ধি আছে।
এটি নির্বাচনপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার একটি ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ প্রকাশ করছেন তাঁরা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারে ১০টি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপও করে সরকার। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন তাঁর পদত্যাগের দাবি তোলে। গত ২২ অক্টোবর বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও পালন করা হয়।
এরপর এই ইস্যুতে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন ছাত্রনেতারা। সেখানে ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে বিএনপিকে তাদের অবস্থান জানানো হয়, কেন তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চান, সেটিও তুলে ধরেন। তবে বিএনপি তাঁদেরকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। দলটি তখন জানায়, এই ইস্যুতে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে তারা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় প্রধান এজেন্ডা ছিল রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু। জানা গেছে, সভার শুরুতে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। এরপর নেতারা তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁরা ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্রে নতুন করে কোনো ধরনের সংকট বা জটিলতা সৃষ্টি হোক—এমন পরিস্থিতি সতর্কভাবে এড়িয়ে চলার অবস্থান প্রকাশ করেন; বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ প্রশ্নে।
সভায় কেউ কেউ বলেছেন, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ঘোষণাপত্র) ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবি তোলা হয়েছে। এ জন্য যদি সংবিধান বাতিল করা হয়, তাহলে দেশে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। তাঁরা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সাংবিধানিক সংকট এ জন্য সৃষ্টি হবে যে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন, সে ধরনের কোনো অপশন খোলা নেই। প্রধান বিচারপতিও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বলে সভায় একজন জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে ১০টি কমিশন গঠন করেছে। তারাই মতামত দেবে কী ধরনের সংস্কার হতে পারে রাষ্ট্রের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। বাইরে থেকে নানা ধরনের দাবি তুললে কমিশন ঠিকমতো কাজটা করতে পারবে না।
স্থায়ী কমিটির সভায় এবার ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই দিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (বীর-উত্তম) মাজারে বড় ধরনের শোডাউন করবে দলটি। দেশব্যাপীও বৃহৎ আকারে দিবসটি পালিত হবে।
সভায় মতামত এসেছে, দ্রুততম সময়ে সরকারের উচিত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া। বিএনপি আগামী দিনে তাদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সব ধরনের কর্মসূচিতে দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সোচ্চার হবে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে দলটি।
এর আগে গত ২২ অক্টোবর রাতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে নেতারা অভিমত দেন, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। এমনটা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে।এতে নির্বাচন আরো দীর্ঘায়িত হবে। এরপর ২৩ অক্টোবর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপির এমন অবস্থানে রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের দাবি কিছুটা থমকে যায়। দলীয় এমন সিদ্ধান্তের আলোকে ২৩ অক্টোবর বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল যমুনায় গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে।সেখানে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি নেতারা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে এই মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হোক, সেটা কাম্য নয় বিএনপির।
কালের কণ্ঠের